বিদায় হজ
বিদায় হজ ও এর সময় নির্বাচন:
আল্লাহর ইচ্ছা পূর্ণ হলো। উম্মাহর আত্মাসমূহ মূর্তিপূজার আবর্জনা ও জাহেলিয়াতের অভ্যাস থেকে পাক-পবিত্র হলো এবং আলোকিত হলো ঈমানী রৌশনিতে। তাদের দিলে প্রেম ও ভালোবাসার স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি হলো। আল্লাহর ঘর পবিত্র কা‘বা মূর্তি থেকে ও মূর্তির পূতি-গন্ধময় আবর্জনা থেকে মুক্ত ও পাক-সাফ হলো। মুসলিমদের ভিতর (যারা বহু দিন হয় বায়তুল্লাহ’র হজ ও যিয়ারত করেনি) হজের প্রতি নবতর আগ্রহের সৃষ্টি হয় এবং প্রেম ও ভালোবাসার পেয়ালা কেবল পূর্ণই হয় নি বরং উছলে পড়ার উপক্রম হয়। অপর দিকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার মুহূর্তও খুব কাছাকাছি ঘনিয়ে আসে। আর অবস্থার দাবিও হলো যে, উম্মাহকে বিদায় সালাম জানাতে হবে। তখন আল্লাহ তা‘আলা তদীয় হাবীব নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে (১০ম হি.) হজের অনুমতি দিলেন। ইসলামে এটি ছিল তাঁর প্রথম হজ।
বিদায় হজের দাওয়াতী, তাবলিগী ও তরবিয়তী গুরুত্ব:
তিনি মদিনা থেকে এই উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন যে, বায়তুল্লাহ’র হজ করবেন, মুসলিমদের সঙ্গে মিলিত হবেন, তাদের দীনের তা‘লীম দিবেন, হজের নিয়ম-কানূন শিখাবেন, সত্যের সাক্ষ্য প্রদান করবেন, আপন অপরিহার্য দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করবেন, জাহেলিয়াতের শেষ চিহ্নটুকু মুছে ফেলবেন এবং পায়ের তলে দাফন করবেন। এই হজ হাজারো ওয়াজ-নসীহত, হাজারো দরস ও তা‘লীমের স্থলাভিষিক্ত ছিল। এটি ছিল একটি চলতি ও ভ্রাম্যমাণ মাদরাসা, একটি সক্রিয় ও গতিশীল মসজিদ এবং একটি চলন্ত ছাউনি যেখানে একজন মূর্খ-জাহিল, ইলম দ্বারা সজ্জিত হবে, গাফিল তার গাফলত থেকে সজাগ হবে, অলস চঞ্চল হবে, কমজোর শক্তিশালী ও বলবান হবে। রহমতের একটি মেঘ, সফরে ও বাড়ি-ঘরে অবস্থানরত সর্বাবস্থায় ও সর্বমূহূর্তে তাঁকে ছায়াদান করত। এ ছিল রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহচর্য, তাঁর স্নেহ ও ভালোবাসা, তাঁর প্রশিক্ষণ, তত্ত্বাবধান ও নেতৃত্বরূপী রহমতের মেঘ।
বিদায় হজ ঐতিহাসিক রেকর্ড:
সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুমের ন্যায় বিশ্বস্ত ও ন্যায়পরায়ণ বর্ণনাকারীগণ এ সফরে নাজুক থেকে নাজুকতর দিক এবং ক্ষুদ্র থেকে ক্ষদ্রাতিক্ষুদ্র ঘটনার এমন একটি রেকর্ড আমাদের জন্য সংরক্ষণ করে গেছেন যার নজির না রাজা-বাদশাহ কিংবা আমীর-উমারার সফরনামাগুলোতে পাওয়া যাবে, আর না পাওয়া যাবে ওলামা ও মাশায়েখদের কাহিনীতে।
বিদায় হজের সাধারণ পর্যালোচনা:
আমরা এ হজ সফরের সংক্ষিপ্তসার এখানে পেশ করছি যাকে ‘হজ্জাতুল-বিদা’, ‘হজ্জাতুল-বালাগ’ ও ‘হজ্জাতুত-তামাম’ নামে স্মরণ করা হয় থাকে। আসলে এগুলোরই সমাহার ছিল এ হজ; বরং এসবের চাইতেও ভিন্ন কিছু। এ সফরে তাঁর সঙ্গে এক লক্ষের বেশি সাহাবী শরীক ছিলেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কীভাবে হজ করলেন:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম হজের সংকল্প করলেন এবং দশম হিজরীর যিলকদ মাসে লোকদেরকে জানিয়ে দিলেন যে, তিনি এবার হজে যাচ্ছেন। এতদশ্রবণে লোকেরা তাঁর সঙ্গে হজ গমনের আশায় প্রস্তুতি শুরু করে দেয়।
এ খবর মদিনার চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং সেসব এলাকার লোকেরাও দলে দলে মদিনায় এসে উপস্থিত হয়। পথিমধ্যে এত বিপুল সংখ্যক লোক কাফেলায় শামিল হয় যে, এর সংখ্যা কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিল। এ ছিল যেন এক মানব সমুদ্র! সামনে পিছনে ডানে বামে যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু মানুষ আর মানুষ তাঁকে ঘিরে রেখেছে। তিনি মদিনা থেকে ২৫ যিলকদ রোজ শনিবার যোহর বাদ রওয়ানা হন। প্রথমে যোহরের সালাত আদায় করেন। এর পূর্বে একটি খুতবা দেন এবং এতে ইহরামের ওয়াজিব ও সুন্নাতসমূহের বর্ণনা দেন। এরপর (যখন ইহরাম বাঁধেন তখন) তালবিয়া পাঠ করতে করতে রওয়ানা হন।
«لَبَّيْكَ اللهم لَبَّيْكَ، لَبَّيْكَ لاَ شَرِيكَ لَكَ لَبَّيْكَ، إِنَّ الْحَمْدَ، وَالنِّعْمَةَ، لَكَ وَالْمُلْكَ، لاَ شَرِيكَ لَكَ».
বিশাল জনসমুদ্র এ তালবিয়া কখনো সংক্ষেপে, কখনো বা কমিয়ে বাড়িয়ে বলছিল। কিন্তু এতে তিনি কাউকে কিছু বলেননি! তালবিয়া পাঠের সিলসিলা তিনি অব্যাহত রাখেন। অতঃপর ‘আরাজ নামক স্থানে পৌঁছে ছাউনি ফেলেন। এ সময় তাঁর সওয়ারী ও আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুর সাওয়ারী একই ছিল।
অতঃপর তিনি সামনে অগ্রসর হলেন এবং ‘আবওয়া’ নামক স্থানে পৌঁছলেন। সেখান থেকে রওয়ানা হয়ে উসফান ও সারিফ উপত্যকায় পৌঁছান। অতঃপর সেখান থেকে যাত্রা করে ‘জি-তুওয়া’ নামক স্থানে মনযিল করলেন এবং শনিবার রাত সেখানে অতিবাহিত করেন। সেদিন ছিল যিলহজ মাসের ৪ তারিখ। ফজরের সালাত সেখানেই আদায় করেন। ঐ দিনই তিনি গোসল করেন এবং মক্কাভিমুখে রওয়ানা হন। তিনি দিনের বেলা উচ্চভূমি দিয়ে মক্কায় প্রবেশ করেন। সেখান দিয়ে হারাম শরীফে প্রবেশ করেন। এ সময় ছিল চাশতের ওয়াক্ত। যখন হারাম শরীফে প্রবেশ করলেন তখন সর্বপ্রথম কা‘বা শরীফের দিকে ফিরলেন। হাজরে আসওয়াদ সামনাসামনি হতেই তিনি কোনোরূপ বাধা-প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই তাতে চুমু খেলেন। এরপর তাওয়াফের উদ্দেশ্যে ডান দিকে ফিরলেন। এ সময় বায়তুল্লাহ তাঁর বাম দিকে ছিল। এ তাওয়াফের প্রথম তিন চক্রে রমল করেন। অর্থাৎ ছোট ছোট কদম ফেলে দ্রুত গতিতে চলছিলেন। চাদর এক কাঁধের উপর ফেলে রেখেছিলেন আর অপর কাঁধ ছিল খালি -এভাবে ইদ্বতিবা করেছিলেন। তিনি যখন হাজরে আসওয়াদ অতিক্রম করছিলেন তখন সেদিকে ইশারা করে আপন ছড়ির সাহায্যে ইসতিলাম করছিলেন। তাওয়াফ শেষ হতেই মাকামে ইবরাহীমের পেছনে গেলেন এবং এ আয়াত তিলাওয়াত করলেন:
﴿وَٱتَّخِذُواْ مِن مَّقَامِ إِبۡرَٰهِۧمَ مُصَلّٗى﴾ [البقرة: ١٢٥]
“তোমরা মাকামে ইবরাহীমকে সালাতের স্থান বানাও।” [সুরা আল-বাকারাহ: ১২৫]
এরপর এখানে দুই রাকাত সালাত আদায় করলেন। সালাত সমাপনান্তে পুনরায় হজরে আসওয়াদের নিকট গমন করলেন এবং তাতে চুমু খেলেন। এরপর সাফা পর্বতের দিকে সম্মুখস্থ দরজা হয়ে চললেন। কাছাকাছি হতেই বললেন,
﴿إِنَّ ٱلصَّفَا وَٱلۡمَرۡوَةَ مِن شَعَآئِرِ ٱللَّهِۖ﴾ [البقرة: 158] «أَبْدَأُ بِمَا بَدَأَ اللهُ بِهِ»
“সাফা ও মারওয়া আল্লাহর নিদর্শনগুলোর অন্তর্ভুক্ত। আমি সেখান থেকে শুরু করছি যা দ্বারা আল্লাহ শুরু করেছেন।” (অর্থাৎ আল্লাহ সাফা পাহাড়ের কথা আয়াতে আগে বলেছেন তাই আমি তা দিয়ে সা‘ঈ শুরু করছি)।
এরপর তিনি তাতে (সাফা পাহাড়ে) আরোহণ করলেন। এমনকি ততদূর অবধি আরোহণ করলেন যেখান থেকে বায়তুল্লাহ দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল। অতঃপর কিবলার দিকে ফিরে আল্লাহ তা‘আলার একত্ব ও তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা দিয়ে বললেন,
«الله أكبر، الله أكبر، الله أكبر، لااله الا الله وحده لا شريك له، له الملك وله الحمد وهو على كل شئ قدير، لااله الا الله وحده لا شريك له، أنجز وعده و نصر عبده و هزم الأحزاب وحده».
“আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান, আল্লাহ মহান, একমাত্র আল্লাহ ভিন্ন কোনো মা‘বুদ নেই, তাঁর কোনো শরীক নেই। রাজত্ব তাঁর আর সকল হামদ তথা প্রশংসাও তাঁরই। তিনি সকল বিষয়ের ওপর ক্ষমতাবান। আল্লাহ ভিন্ন কোনো মা‘বূদ নেই, তিনি এক তাঁর কোনো শরীক নেই, তিনি তাঁর ওয়াদা পালন করেছেন, আপন বান্দাকে সাহায্য করেছেন এবং সমস্ত দল ও উপদলকে একা পর্যুদস্ত করেছেন।”
মক্কায় তিনি ৪/৫ দিন (শনি, রবি, সোম, মঙ্গল ও বুধবার এ কয়দিন) অবস্থান করেন। বৃহস্পতিবার বেলা উঠতেই সকল মুসলিমকে নিয়ে মিনায় গমন করেন। যোহর, আসর, মাগরিব, এশা ও ফজর সালাত তিনি এখানেই আদায় করেন এবং এখানেই রাত্রিযাপন করেন। এদিন ছিল বৃহস্পতিবার দিবাগত জুমু‘আর রাত্রি। সূর্য উঠতেই তিনি ‘আরাফাতের দিকে অগ্রসর হলেন। তিনি দেখতে পেলেন যে, নামিরায় তাঁর জন্য তাঁবু স্থাপন করা হয়েছে। অনন্তর তিনি এখানেই অবতরণ করলেন। এখানে তিনি ভাষণ দেন। যে ভাষণে তিনি ইসলামের বুনিয়াদসমূহ খোলাখুলিভাবে তুলে ধরেন এবং শির্ক ও মূর্খতার বুনিয়াদ ধ্বংস করে দেন। এ ভাষণে তিনি সেসব হারাম বস্তুকে হারাম বলে ঘোষণা করেন, যেগুলো হারাম হওয়ার ব্যাপারে দুনিয়ার তাবত ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠী ঐকমত্য পোষণ করে। আর তা ছিল অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা, ধন-সম্পদ ছিনতাই করা, নারীর সতীত্ব-সম্ভ্রম নষ্ট করা। জাহেলিয়াতের তাবত বিষয়াদি ও প্রচলিত কাজগুলো আপন কদমতলে দাফন করেন। জাহেলিয়াত আমলের সূদ তিনি সমূলে খতম করেন এবং একে সম্পূর্ণ বাতিল বলে অভিহিত করেন। তিনি মহিলাদের সঙ্গে উত্তম আচার-আচরণের উপদেশ দেন এবং তাদের যে সমস্ত অধিকার রয়েছে; অধিকন্তু তাদের জিম্মায় যেসব অধিকার রয়েছে, তার বিশ্লেষণ করেন এবং বলেন যে, নিয়ম মোতাবক আহার, পোশাক ও খোরপোশ তাদের অধিকার।
উম্মতকে তিনি আল্লাহর কিতাবের সঙ্গে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে থাকার অসিয়ত করেন এবং বলেন, যতদিন তোমরা এর সঙ্গে নিজেদের ভালোভাবে আঁকড়ে রাখবে ততদিন তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। তিনি তাদেরকে সতর্ক করেন যে, তাদেরকে কিয়ামতের দিন তাঁর সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে এবং তাদেরকে এর জওয়াব দিতে হবে। এ সময় তিনি উপস্থিত সকলকে জিজ্ঞেস করেন, তখন তারা তাঁর সম্পর্কে কি বলবে এবং কি সাক্ষ্য দেবে? সকলেই সমস্বরে বললেন: আমরা সাক্ষ্য দেব যে, আপনি পয়গামে হক এতটুকু কম-বেশি না করে ঠিক ঠিক পৌঁছে দিয়েছেন, আপন দায়িত্ব পালন করেছেন এবং কল্যাণ কামনার হকও আদায় করেছেন। এতদশ্রবণে তিনি আসমানের দিকে আঙ্গুল উঠালেন এবং তিনবার আল্লাহ তা‘আলাকে এ বিষয়ে সাক্ষী বানালেন। এরপর তাদেরকে হুকুম দিলেন যে, যারা এখানে উপস্থিত আছে তারা অনুপস্থিত লোকদেরকে এ কথাগুলো যেন পৌঁছে দেয়।
খুতবা শেষ হতেই বেলাল রাদিয়াল্লাহু আনহুকে আযান দেওয়ার হুকুম দিলে তিনি আযান দিলেন। এরপর তিনি যোহরের সালাত দুই রাকাত আদায় করলেন। ঠিক সেভাবে আসরেরও দু‘রাকাতই পড়লেন। দিনটা ছিল জুমু‘আর দিন। সালাত শেষ হতেই সওয়ারীতে আরোহণ করলেন এবং সেই উকূফের জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালেন যেখানে তিনি দীর্ঘক্ষণ ধরে দো‘আ করেছিলেন (জায়গাটি আজ অবধি ‘আরাফাতে বিখ্যাত ও চিহ্নিত)। এখানে এসে তিনি তাঁর উটের উপর বসলেন এবং সূর্যাস্ত পর্যন্ত দো‘আ ও মোনাজাত, মহান আল্লাহ সমীপে কান্নাকাটি, আপন দুর্বলতা ও অসহায়ত্বের বিনীত প্রকাশের মাঝেই মশগুল থাকলেন। দো‘আরত আবস্থায় তিনি তাঁর হাত উপরের দিকে তুলতেন, যেমন কোনো ভিক্ষুক-প্রার্থী ও অসহায় মিসকীন এক টুকরো রুটি যাঞ্ছা করছে।
এ সময় সূরা আল-মায়েদার এ আয়াতটি নাযিল হয়,
﴿ٱلۡيَوۡمَ أَكۡمَلۡتُ لَكُمۡ دِينَكُمۡ وَأَتۡمَمۡتُ عَلَيۡكُمۡ نِعۡمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ ٱلۡإِسۡلَٰمَ دِينٗاۚ﴾ [المائدة: ٣]
“আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দীনকে পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের ওপর আমার নি‘আমত সম্পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের জন্য দীন হিসেবে পছন্দ করলাম ইসলামকে। [সূরা আল-মায়েদাহ: ৩]
সূর্যাস্তের পর তিনি ‘আরাফাত থেকে রওয়ানা হলেন এবং উসামা ইবন যায়েদ রাদিয়াল্লাহু আনহুকে নিজের পিছনে বসিয়ে নিলেন। তিনি দৃঢ় প্রশান্ত চিত্তে ও ভাবগম্ভীর মর্যাদাসহ সম্মুখে অগ্রসর হলেন। উটনীর রশি তিনি এভাবে গুছিয়ে নিয়েছিলেন যে, মনে হচ্ছিল তাঁর মস্তক বুঝি উটনীর কুঁজ স্পর্শ করবে। তিনি বলে চলছিলেন, লোক সকল! নিরাপদ প্রশান্তির সঙ্গে চল। গোটা রাস্তা তিনি তালবিয়া পাঠ করছিলেন যতক্ষণ না মুযদালিফা গিয়ে পৌঁছেন -এ ধারা অব্যাহত থাকে। মুজদালিফায় পৌঁছেই সাহাবী বেলাল রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুকে আযান দিতে বললেন। আযান দেওয়া হলো। তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন এবং উট বসানো ও সামান নামানোর আগেই মাগরিবের সালাত আদায় করলেন। তারপর তিনি সালাতুল-ইশা আদায় করলেন। এরপর তিনি আরাম করার জন্য শুয়ে পড়লেন এবং ফজর অবধি ঘুমালেন।
আওয়াল ওয়াক্তে সালাতুল-ফজর আদায় করলেন। এরপর সাওয়ারীর পৃষ্ঠে আরোহণ করলেন এবং মাশ‘আরুল-হারাম-এ আসলেন ও কেবলামুখী হয়ে দো‘আ ও মিনতিভরা কান্না, তাকবীর-তাহলীল ও যিকির-এ মশগুল হলেন। পূর্ব আকাশ ফর্সা হয়ে যাওয়া অবধি তিনি এতে মশগুল রইলেন। এ ছিল সূর্যোদয়ের পূর্বের অবস্থা। অতঃপর তিনি মুযদালিফা থেকে রওয়ানা হন। ফযল ইবন আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুমা এ সময় তাঁর উটনীর পৃষ্ঠে তাঁর পশ্চাতে উপবিষ্ট ছিলেন। তিনি বরাবরের মতোই তালবিয়া পাঠ করছিলেন। ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমাকে নির্দেশ দিলেন, জামরায়ে ‘আকাবায় নিক্ষেপের জন্য সাতটি পাথর কুড়িয়ে নাও। ওয়াদিয়ে মুহাস্সারের মাঝামাঝি পৌঁছতেই তিনি তাঁর উটনীর গতি বাড়িয়ে দিলেন এবং তা আরও দ্রুত করলেন। কেননা এটি সেই জায়গা যেখানে হস্তি বাহিনীর ওপর আল্লাহর ‘আযাব নাযিল হয়েছিল। এভাবে তিনি মিনায় পৌঁছলেন এবং সেখান থেকে জামারাতুল-‘আকাবায় তাশরীফ রাখলেন এবং সাওয়ারীতে আরোহণপূর্বক সূর্যোদয়ের পর জামারায় পাথর নিক্ষেপ করেন এবং তালবিয়া পাঠ বন্ধ করেন।
এরপর মিনায় প্রত্যাবর্তন করেন। এখানে তিনি একটি বাগ্মিতাপূর্ণ খুতবা দান করেন। এতে কুরবানির দিনের সম্মান ও মর্যদা সম্পর্কে সকলকে অবহিত করেন এবং আল্লাহ তা‘আলার নিকট এই দিনটির যে বিশেষ মর্যদা রয়েছে তা বর্ণনা করেন।
অপরাপর সমস্ত শহরের ওপর মক্কার যে শ্রেষ্ঠত্ব ও প্রাধান্য রয়েছে তাও উল্লেখ করেন এবং যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাব (কুরআন)-এর আলোকে তাদের নেতৃত্ব দিবে তার অনুসরণ ও আনুগত্য তাদের ওপর ওয়াজিব বলে বর্ণনা করেন। এরপর তিনি উপস্থিত লোকদেরকে তাঁর থেকে হজ ও কুরবানির মাসআলা-মাসায়েল ও নিয়ম-কানূন জেনে নিতে বললেন। তিনি লোকদেরকে এও বললেন, দেখো! আমার পর তোমরা কাফিরে পরিণত হয়ে যেও না, তাদের মতো পরস্পরের গলা কাটতে লেগে যেও না। তিনি আরও নির্দেশ দেন, কথাগুলো অপর লোকদের পৌঁছে দিবে। খুতবায় তিনি এও বললেন:
«اعْبَدُوا رَبَّكُمْ، وَصَلُّوا خَمْسَكُمْ، وَصُومُوا شَهْرَكُمْ، وَأَطِيعُوا ذَا أَمْرِكُمْ تَدْخُلُوا جَنَّةَ رَبِّكُمْ».
“আপন রবের ইবাদত কর, পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় কর, (রমাদ্বান) মাসের সিয়াম পালন কর, শাসন-কর্তৃত্বে সমাসীন ব্যক্তির নির্দেশ পালন কর, (আর) তোমাদের রবের জান্নাতে প্রবেশ কর।”
সে সময় তিনি লোকদের সামনে বিদায় কথাও বলেন এবং এ জন্যই এই হজের নাম ‘বিদায় হজ’।
অতঃপর তিনি মিনায় কুরবানির স্থালে পৌঁছেন এবং তেষট্টিটি উট স্বহস্তে কুরবানী করেন। যতগুলো উট তিনি কুরবানি দিয়েছিলেন হিসাব করে দেখা যায় তত বছরই তিনি হায়াত পেয়েছিলেন। এরপর তিনি ক্ষ্যান্ত হন এবং প্রিয় সাহাবী আলী রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুকে বলেন ১০০ পূরণ হওয়ার যতগুলো বাকী ছিল তা পূরণ করার নির্দেশ দিলেন। কুরবানী সম্পূর্ণ হতেই ক্ষৌরকার ডেকে পাঠান, মস্তক মুণ্ডন করেন এবং মুণ্ডিত কেশ নিকটস্থ লোকদের মধ্যে বন্টন করে দেন। এরপর তিনি মক্কায় রওয়ানা হন। তাওয়াফে ইফাদা আদায় করেন যাকে তাওয়াফে যিয়ারাতও বলা হয়। অতঃপর যমযম কূপের নিকট গমন করেন এবং দাঁড়িয়ে পানি পান করেন। এরপর ঐদিনই মিনায় ফিরে আসেন এবং সেখানে রাত্রি যাপন করেন।
দ্বিতীয় (পর) দিন সূর্য পশ্চিমাকাশে যাওয়ার অপেক্ষা করতে থাকেন। সূর্য ঢলে গেলেই সাওয়ারী থেকে অবতরণ করে পাথর নিক্ষেপের জন্য গমন করেন এবং জামরা-ই উলা থেকে পাথর নিক্ষেপ শুরু করেন, এরপর জামরা-ই উস্তা অতঃপর জামারায়ে ‘আকাবায় সমাপ্ত করেন। মিনায় তিনি দু’টি খুতবা দেন। তন্মধ্যে একটি দেন কুরবানীর দিন, যার কথা আমরা একটু আগেই উল্লেখ করেছি, দ্বিতীয়টি কুরবানীর পরের দিন।
এখানে তিনি যাত্রা বিরতি করেন এবং আয়্যামুত-তাশরীক-এর তিন দিনই পাথর নিক্ষেপ করেন। অতঃপর তিনি মক্কা যাত্রা করেন, শেষ রাত্রে বিদায়ী তাওয়াফ সমাপ্ত করে লোকজনকে তৈরি হওয়ার নির্দেশ দেন এবং মদিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন।
পথে গাদীরে খুম নামক স্থানে পৌঁছে তিনি একটি খুতবা প্রদান করেন এবং তাতে প্রিয় সাহাবী আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুর মর্যাদা ও ফযীলত বর্ণনা করেন। এ সময় তিনি বলেন,
«مَنْ كُنْتُ مَوْلَاهُ فَعَلِيٌّ مَوْلَاهُ، اللَّهُمَّ وَالِ مَنْ وَالَاهُ وَعَادِ مَنْ عَادَاهُ».
“আমি যার প্রিয়, আলীও তার প্রিয় হওয়া উচিৎ। হে আল্লাহ! যে আলীকে ভালোবাসবে তুমিও তাকে ভালোবাস, আর যে তার সঙ্গে শত্রুতা পোষণ করবে তুমিও তার সঙ্গে শত্রুতা পোষণ কর।”
জুল-হুলায়ফা এসে রাত্রি যাপন করেন। সওয়াদ-ই মদিনার প্রতি দৃষ্টিপাত হতেই তিনি তিনবার তকবীর বললেন এবং পাঠ করেন:
«لاإله إلّا الله وحده لاشريك له، له الملك وله الحمد وهو على كل شيء قدير».
“আল্লাহ ব্যতীত আর কোনো সত্য ইলাহ নেই। তিনি এক, তাঁর কোনো শরীক নেই। রাজত্ব তাঁরই, প্রশংসাও তাঁর, আর তিনি সকল কিছুর ওপর ক্ষমতাবান।”
তিনি আরও পাঠ করেন:
«آئبون تائبون عابدون ساجدون لربنا حامدون ، صدق الله وعده ونصر عبده وهزم الأحزاب وحده».
“আমরা প্রত্যাবর্তন করছি তওবারত, অনুগত, সাজদাহ’রত, আমাদের রবের দরবারে প্রশংসারত অবস্থায়। আল্লাহ তাঁর ওয়াদা সত্যে পরিণত করেছেন, তাঁর বান্দাকে সাহায্য করেছেন, সমস্ত দল-উপদলকে এককভাবে পরাজিত করেছেন।”
তিনি দিনের বেলায় মদিনা তায়্যিবাহ’য় প্রবেশ করেন।
বিদায় হজে রাসূল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের খুতবা:
এখানে আমরা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ‘আরাফাত ময়দানে প্রদত্ত খুতবার পূর্ণ অংশ পেশ করছি, ঠিক তেমনি আয়্যামুত-তাশরীকের মধ্যবর্তীতে তাঁর প্রদত্ত খুৎবাও উদ্ধৃত করছি। কেননা এই দু’টি অমূল্য খুতবা সীমাহীন গুরুত্ববহ উপদেশে পরিপূর্ণ এবং অনেক ফলদায়ক।
‘আরাফার খুতবা:
«إن دمائكم و أموالكم حرام عليكم كحرمة يومكم هذا في شهركم هذا في بلدكم هذا ، ألا إن كل شيء من أمر الجاهلية تحت قدمي موضوع , وإن أول دم أضعه من دمائنا دم ابن ربيعة بن الحارث ، كان مسترضعا في بني سعد ، فقتلته هذيل, وربا الجاهلية موضوع وأول ربا أضع من ربانا ربا العباس بن عبد المطلب فإنه موضوع كله , فاتقوا الله فى النساء فإنكم أخذتموهن بأمانة الله واستحللتم فروجهن بكلمة الله ولكم عليهن أن لا يوطئن فرشكم أحدا تكرهونه، فإن فعلن ذلك فاضربوهن ضربا غير مبرح ولهن عليكم رزقهن وكسوتهن بالمعروف, وقد تركت فيكم مالم تضلوا بعده إن اعتصمتم به كتاب الله , وأنتم تسئلون عني فماذا أنتم قائلون ؟ قالوا : نشهد أنك قد بلغت وأديت ونصحت , فقال بإصبعه السبابة يرفعها إلى السماء وينكبها إلى الناس اللهم اشهد ثلاث مرات».
“তোমাদের রক্ত এবং তোমাদের ধন-সম্পদ তেমনি পবিত্র ও সম্মানিত যেমন পবিত্র ও সম্মানিত তোমাদের এ দিন, তোমাদের এ মাস ও তোমাদের এ শহর। মনে রেখো, জাহেলী যুগের সকল কিছুই আমার পদতলে রাখা হলো এবং সাবধান! শুনে রেখো, জাহেলী যুগের অন্যায় রক্তপাতের প্রতিশোধের বিষয়টিও রহিত করা হলো। সর্বপ্রথম আমি আমার আত্মীয় ইবন রবিআ‘ ইবন হারিস হত্যার প্রতিশোধের বিষয়টি রহিত ঘোষণা করছি। তাকে বনী সা‘দ গোত্রে স্তন্য পানের জন্য পাঠানো হয়েছিল। হুযায়ল গোত্রের লোকেরা তাকে সেখানে হত্যা করেছিল। সবশেষে তিনি বললেন, জাহেলী যুগের প্রচলিত সুদের সমস্ত কারবার রহিত করা হলো। সর্বপ্রথম আমি আমার চাচা আব্বাস ইবন ‘আবদিল-মুত্তালিবের সূদি কারবারটি বাতিল ঘোষণা করছি। কেননা এর সবটাই বাতিল। নারীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর। তোমরা তাদেরকে আল্লাহর আমানত হিসেবে গ্রহণ করেছ এবং তাদের সতীত্ব-সম্ভ্রমকে আল্লাহর কালেমার বিনিময়ে তোমাদের জন্য হালাল করেছ। আর তোমাদের ব্যাপারে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো, কোনো লোককে যেন তোমাদের শয্যায় আসতে না দেয় যাকে তোমরা অপছন্দ কর। তারা যদি তা করে তবে তোমরা তাদেরকে প্রহার করবে, তবে এমনভাবে যেন তার চিহ্ন বাইরে ফুটে না ওঠে। আর তাদের ব্যাপারে তোমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো, তোমরা ন্যায়সঙ্গতভাবে তাদের খোরপোশের ব্যবস্থা করবে। আর আমি তোমাদের কাছে একটি জিনিস রেখে যাচ্ছি, তোমরা যদি তা মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরে থাক তবে কখনো পথভ্রষ্ট হবে না। আর তা হলো আল্লাহর কিতাব। তোমাদেরকে আমার সম্পর্কে আল্লাহর দরবারে জিজ্ঞাসা করা হবে সেদিন তোমরা তার কী জবাব দিবে? সাহাবায়ে কেরাম রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুম সমস্বরে উত্তর দিলেন, আমরা বলব, আপনি আল্লাহর পয়গাম আমাদেরকে পৌঁছে দিয়েছেন, আপন দায়িত্ব পালন করেছেন এবং উম্মাহকে উপদেশ দিয়েছেন। অতঃপর তিনি আসমানের দিকে শাহাদাত আঙ্গুলী উচিয়ে তিনবার বললেন, হে আল্লাহ! আপনি সাক্ষী থাকুন।”
আইয়ামে তাশরীক-এর মধ্যবর্তীতে যে খুতবা দিয়েছিলেন তার বক্তব্য ছিল নিম্নরূপ:
«يا أيها الناس هل تدرون فى أي شهر أنتم وفي أي يوم أنتم وفي أي بلد أنتم ؟ فقالوا فى يوم حرام وبلد حرام وشهر حرام , قال : فإن دمائكم وأموالكم وأعراضكم عليكم حرام كحرمة يومكم هذا فى شهركم هذا وفى بلدكم هذا الى يوم تلقونه , ثم قال: اسمعوا ألا لاتظلموا, ألا لاتظلموا ، إنه لايحل مال امرئ مسلم إلابطيب نفس منه ، ألا وإن كل دم ومال ومأثرة كانت في الجاهلية تحت قدمي هذه إلى يوم القيامة , وإن أول دم يوضع دم ربيعة بن الحارث بن عبد المطلب كان مسترضعا في بني ليث فقتلته هذيل, وإن كل ربا فى الجاهلية موضوع وإن الله عز وجل قضى وأن أول ربا يوضع ربا العباس بن عبد المطلب ولكم رؤوس أموالكم لايظلمون, ألا وإن الزمان قد استدارك هيئته يوم خلق السموات الأرض ثم قرأ: ﴿إِنَّ عِدَّةَ ٱلشُّهُورِ عِندَ ٱللَّهِ ٱثۡنَا عَشَرَ شَهۡرٗا فِي كِتَٰبِ ٱللَّهِ يَوۡمَ خَلَقَ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضَ مِنۡهَآ أَرۡبَعَةٌ حُرُمٞۚ ذَٰلِكَ ٱلدِّينُ ٱلۡقَيِّمُۚ فَلَا تَظۡلِمُواْ فِيهِنَّ أَنفُسَكُمۡۚ﴾ [التوبة: ٣٦]
ألا لا ترجعوا بعدي كفارا يضرب بعضكم رقاب بعض, ألا أن الشيطان قد أيس أن يعبده المصلون , ولكنه في التحريش بينكم، واتقوا الله في النساء، فإنهن عندكم عوان لايملكن لأنفسهن شيئا وإن لهن عليكم حقا ولكم عليهن حقا أن لا يوطئن فرشكم أحدا غيركم, ولايأذين في بيوتكم لأحد تكرهونه, فإن خفتم نشوزهن فعظوهن واهجروهن في المضاجع واضربوهن ضربا غير مبرح ولهن رزقهن وكسوتهن بالمعروف وانما أخذتموهن بأمانة الله , واستحللتم فروجهن بكلمة الله عز وجل, ألا ومن كانت عنده أمانة فليؤدها إلى من ائتمنه عليها، وبسط يديه وقال ألا هل بلغت ألا هل بلغت , ثم قال ليبلغ الشاهد الغائب, فان رُبَّ مبلغ أسعد من سامع».
“লোক সকল! তোমরা কি জান কোন মাস, কোন দিন এবং কোন শহরে আছ তোমরা? জবাবে লোকেরা বলল, সম্মানিত দিনে, সম্মানিত শহরে এবং সম্মানিত মাসে আমরা আছি। তিনি বললেন, তোমাদের রক্ত, তোমাদের ধন-সম্পদ তোমাদের সম্মান, সম্মানিত যেমন সম্মানিত আজকের এ দিন, এ মাস ও এই শহর। অতঃপর বললেন, আমার কথা শোন যাতে তোমরা সহীহ-শুদ্ধ জীবন যাপন করতে পার। সাবধান! তোমরা যুলুম করবে না। সাবধান! তোমরা যুলুম করবে না। খবরদার! তোমরা যুলুম করবে না। আর কোনো মুসলিমের ধন-সম্পত্তি থেকে তার সম্মতি ব্যতিরেকে কোনো কিছু গ্রহণ করা তোমাদের জন্য বৈধ নয়। সর্বপ্রকার রক্ত, সব ধরনের ধন-সম্পদ, যা জাহেলী যুগ থেকে চলে আসছে তা কিয়ামত পর্যন্ত বাতিল ঘোষিত হলো। সর্বপ্রথম যে রক্ত (প্রতিশোধ হিসেবে) বাতিল ঘোষিত হচ্ছে তা রবিআ‘ ইবনুল-হারিস ইবন আবদিল-মুত্তালিবের রক্ত, সে বনী লায়স-এ প্রতিপালিত হয়েছিল এবং হুযায়ল গোত্রের লোকেরা হত্যা করেছিল। জাহেলী যুগের সর্বপ্রকার সূদ রহিত করা হলো এবং আল্লাহ তা‘আলার ফয়সালা এই যে, সর্বপথম যেই সূদ রহিত করা হবে তা হবে আব্বাস ইবন আব্দুল-মুত্তালিবের সূদ। তবে তোমরা তোমাদের মূলধন ফিরে পাবে। এ ব্যাপারে তোমরা নিজেরা অত্যাচারিত হবে না আর তোমারা কারো ওপর যুলুম করবে না। আদিতে তিনি যখন আসমান জমিন সৃষ্টি করেছিলেন, কালের আবর্তন-বিবর্তনে আজ সেখানেই এসে পৌঁছেছে। এরপর তিনি তিলাওয়াত করলেন,
﴿إِنَّ عِدَّةَ ٱلشُّهُورِ عِندَ ٱللَّهِ ٱثۡنَا عَشَرَ شَهۡرٗا فِي كِتَٰبِ ٱللَّهِ يَوۡمَ خَلَقَ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضَ مِنۡهَآ أَرۡبَعَةٌ حُرُمٞۚ ذَٰلِكَ ٱلدِّينُ ٱلۡقَيِّمُۚ فَلَا تَظۡلِمُواْ فِيهِنَّ أَنفُسَكُمۡۚ﴾ [التوبة: ٣٦]
“আল্লাহর নিকট গণনার মাস হিসাবে বার মাস, সেদিন থেকে যেদিন তিনি আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ কর্তৃত নির্ধারিত সময় হিসাবে। এর মধ্যে চারটি মাস পরম সম্মানিত। আর এটাই আল্লাহর সুস্পষ্ট দীন বা জীবন-বিধান। অতএব, তোমরা এই মাসগুলোতে (অন্যায় হত্যাকাণ্ডে জাড়িত হয়ে) নিজেদের ওপর যুলুম করো না।” [সূরা আত-তাওবাহ: ৩৬]
আর হ্যাঁ, আমার পর আমার অবর্তমানে তোমরা পরস্পর মারামারি করে কাফির হয়ে যেও না। মনে রেখো! শয়তান এ বিষয়ে নিরাশ হয়ে গেছে যে, যারা সালাত আদায় করে তারা কোনোদিন তার পূজারী হবে না। তবে হ্যাঁ, সে তোমাদের বিভিন্ন রকমের চক্রান্তে উস্কানি দিবে। নারীদের ব্যাপারে তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। কেননা তারা তোমাদের তত্ত্বাবধানে আছে। তারা নিজেদের ব্যাপারে স্বাধীনভাবে কিছু করতে সক্ষম নয়। তোমাদের ওপর তাদের অধিকর রয়েছে এবং তাদের ওপরও তোমাদের অধিকার রয়েছে। তাদের ওপর তোমাদের অধিকার হলো, তারা আপন স্বামী ছাড়া তাদের শয্যায় কাউকে প্রবেশাধিকার দিবে না এবং তোমাদের অপছন্দীয় কাউকে তোমাদের ঘরে প্রবেশের অনুমতি দিবে না। যদি তাদের থেকে অবাধ্যতার আশংকা কর তাহলে তাদেরকে উপদেশ দাও, বুঝাও এবং তাদেরকে শয্যায় পরিত্যাগ কর, পৃথক করে দাও এবং তাদের হাল্কাভাবে প্রহার কর আর তাদের ন্যাসঙ্গতভাবে খোরপোশ প্রদান কর। এ তাদের প্রাপ্য অধিকার। কেননা তোমরা তাদেরকে আল্লাহর নামে তাঁর আমানত হিসেবে গ্রহণ করেছ এবং আল্লাহর নামে তাদের সতীত্ব-সম্পদ নিজেদের জন্য বৈধ করেছ। মনে রেখো, কারো কাছে অপর কারোর আমানত রক্ষিত থাকলে সে যেন আমানতকারীর নিকট তা প্রত্যর্পন করে। এতদূর বলার পর তিনি আপন হস্তদ্বয় প্রসারিত করলেন এবং বললেন, আমি কি তোমাদেরকে পয়গাম পৌঁছে দিয়েছি? আমি কি পয়গাম পৌঁছে দিয়েছি? অতঃপর যারা এখানে উপস্থিত আছ তারা যেন অনুপস্থিত লোকদের কাছে তা পৌঁছে দেয়। কেননা এমন অনেক অনুপস্থিত লোক আছে যারা উপস্থিত শ্রোতাদের তুলনায় অধিকতর ভাগ্যবান হয়ে থাকে।”
সমাপ্ত
লেখক: আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.)
সম্পাদনা: প্রফেসর ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া