নববর্ষ : আত্মপর্যালোচনার দারুণ উপলক্ষ
আবার এলো নববর্ষ। আবারো নববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে বিশ্বজুড়ে অপচয় করা হবে কোটি কোটি ডলার। আতশবাজি, উদ্দাম নৃত্য, গান পরিবেশন, যুবক-যুবতীদের প্রণয় বিনিময়, একান্তে সময় কাটানো, বন্ধু বান্ধবীদের উদ্দেশে মোবাইল, মেইল বা সামাজিক যোগাযোগের সাইটের মাধ্যমে শুভেচ্ছা বিনিময়, মদ্য পান ও নারী নিয়ে ফূর্তি করাসহ রকমারি আয়োজনের মধ্য দিয়ে বিদায় দেয়া হবে ২০১৫ সালকে। বরণ করা হবে ২০১৬ সাল। দেশের ফাইভ স্টার হোটেলগুলো ও পর্যটন স্পটগুলোয় আয়োজন করা হবে নানা অনুষ্ঠানের। মোবাইল কোম্পানিগুলোর হাওয়া থেকে উপার্জিত অর্থের সৌজন্যে কক্সবাজারে আয়োজন করা হবে চোখ ধাঁধানো বর্ষবরণ উৎসবের। Happy new year 2016 লেখায় রাস্তা ও দেয়ালগুলো সুশোভিত হয়ে উঠবে। নতুন বর্ষকে বরণের উৎসব করতে গিয়ে আরো কত কিছুই না করা হবে!
আচ্ছা, আমরা কি ভেবে দেখেছি একটি বছরের বিদায় শুধু আনন্দের বিষয়? কেবলই ফূর্তি ও উল্লাস প্রকাশের উপলক্ষ? নাহ, এ কেবল আনন্দের বিষয় হতে পারে না। বরং এটি আমাদের চিন্তা-ভাবনা ও পর্যালোচনার মোক্ষম উপলক্ষ বৈ কি। কেন? কারণ, একটি বছরের সাথে সাথে আমাদের জীবন নামক প্রাসাদ থেকে ৩৬৫ দিনের ৩৬৫টি পাথর খসে পড়ে। ছোট হয়ে আসে আমাদের নাতিদীর্ঘ জীবন। আমরা বিগত বছরটি কিভাবে কাটিয়েছি, আগামী বছর কিভাবে কাটাবো এবং এ বছর আমার অর্জন কী কী? ইত্যকার আরো নানা প্রশ্ন ঘিরে ধরা উচিত আমাদের চেতনা জগতকে।
এখন আমাদের আনন্দ-উল্লাসের এতটুকু ফুরসত থাকার কথা নয়। এখন শুধু হিসাব-নিকাশ মেলাবার সময়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দ্বিতীয় খলীফা উমার ইবনুল খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, “তোমাদের কাছে হিসাব চাওয়ার আগে নিজেরাই নিজেদের হিসাব সম্পন্ন করে নাও, তোমাদের আমল ওজন করার আগে নিজেরাই নিজেদের আমলসমূহ ওজন করে নাও, কিয়ামত দিবসে পেশ হওয়ার জন্য নিজেদের প্রস্তুত কর। সুসজ্জিত হও সেদিনের জন্য, যেদিন তোমাদের সামনে কোনো কিছু অস্পষ্ট থাকবে না।”
আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপে ভেবে দেখা দরকার, আমরা কী করছি? এর পরিমাণ কী? হাসান বসরী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, “আল্লাহ ওই বান্দার ওপর রহম করেন, যে তার পদক্ষেপে থামে। (এবং চিন্তা করে) যদি তা আল্লাহর জন্য হয় তা সম্পন্ন করে আর যদি তা হয় অন্য কারও জন্য তবে তা বিলম্বিত করে।”
আমরা তো কিঞ্চিৎ নেক আমল করেই তৃপ্তির ঢেকুর তুলি। ইবন আবী মুলাইকাহ্ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, “আমি ত্রিশজন নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীকে পেয়েছি, তাঁরা প্রত্যেকেই নিজের নিফাক সম্পর্কে সন্ত্রস্ত ছিলেন। তাঁদের কেউ এমন ছিলেন না, যিনি বলতেন যে তিনি জিবরীল এবং মিকাঈলের মতো ঈমানের ওপর আছেন।”
বিশ্বের অন্যতম সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম নাগরিকের দেশ বাংলাদেশে টিএসসিসহ উল্লেখযোগ্য সাংস্কৃতিক স্পটগুলোতে থার্টি ফার্স্ট নাইটে নববর্ষ উদযাপরনের নামে যেভাবে বেহায়া ও বেলেল্লাপনা, অবাধ যৌনাচার ও অপ্রীতিকর ঘটনার অবতারণা হয়, তা একেবারেই অনভিপ্রেত। বাধ্য হয়ে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কড়া নিরাপত্তা গ্রহণ করতে হয়। ২০০০ সালে থার্টি ফার্স্ট নাইটে বাঁধন নামের একটি মেয়ে শারীরিকভাবে লাঞ্চিত ও অপমানিত হয়েছিল। যা বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষকে আহত ও অপমানিত করেছিল।
দু’ বছর আগে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে থার্টি ফার্স্ট নাইট পালন করতে গিয়ে কয়েকজন প্রাণ হারিয়েছিলেন। এর বছর তিনেক আগে ব্যাংককের একটি নাইটক্লাবে থার্টি ফার্স্ট নাইটে প্রাণ দিতে হয়েছে কমপক্ষে ৬০ জনকে। আহত হয়েছে আরো অনেকে। থাইল্যান্ডের ওই ক্লাবে তারা যখন আনন্দে আত্মহারা ঠিক তখনই বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটের মাধ্যমে আগুনের লেলিহান শিখা তাদের বেষ্টন করে নেয়। নিমিষেই সমাপ্তি ঘটে সকল আনন্দ-উল্লাসের। এরপরও কি কেউ শিক্ষা গ্রহণ করেছে? তওবা করে ফিরে এসেছে চির শান্তির পথে? অথচ আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلَنُذِيقَنَّهُم مِّنَ ٱلۡعَذَابِ ٱلۡأَدۡنَىٰ دُونَ ٱلۡعَذَابِ ٱلۡأَكۡبَرِ لَعَلَّهُمۡ يَرۡجِعُونَ ٢١﴾ [السجدة: ٢١]
“আর অবশ্যই আমরা তাদেরকে গুরুতর আযাবের পূর্বে লঘু আজাব আস্বাদন করাব, যাতে তারা ফিরে আসে।”[১]
অন্য এক আয়াতে আল্লাহ বলেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱتَّقُواْ ٱللَّهَ وَلۡتَنظُرۡ نَفۡسٞ مَّا قَدَّمَتۡ لِغَدٖۖ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَۚ إِنَّ ٱللَّهَ خَبِيرُۢ بِمَا تَعۡمَلُونَ ١٨ وَلَا تَكُونُواْ كَٱلَّذِينَ نَسُواْ ٱللَّهَ فَأَنسَىٰهُمۡ أَنفُسَهُمۡۚ أُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡفَٰسِقُونَ ١٩﴾ [الحشر: ١٨، ١٩]
“হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর; আর প্রত্যেকের উচিত চিন্তা করে দেখা সে আগামীকালের জন্য কি প্রেরণ করেছে; তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। তোমরা যা কর নিশ্চয় আল্লাহ সে বিষয়ে সম্যক অবহিত। তোমরা তাদের মতো হইও না, যারা আল্লাহকে ভুলে গিয়েছিল ফলে আল্লাহও তাদেরকে আত্মবিস্মৃত করে দিয়েছিলেন; আর তারাই হলো ফাসিক।”[২]
আমরা সব অভিভাবকই চাই আমাদের কোমলমতি সন্তানদের জীবন হোক নিরোগ, নিটোল ও অনাবিল সুন্দর। কিন্তু আমরা কি ভেবে দেখেছি নববর্ষের মতো এরূপ নানা উপলক্ষে যখন নিজেদের শাসনের বাঁধন একটু শিথিল করি, একটু সুযোগ দেই গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসাবার তখনই তাদেরকে বন্ধু-সতীর্থরা নিয়ে যায় লক্ষ্যহীন সাময়িক সুখের জীবনে। মাদক ও নেশার ভুবনে। যে ভুবন একটি শান্ত পুষ্পিত জীবনকে করে অশান্ত পূঁতি-গন্ধময়। যে জগত একজন ভদ্র সুবোধ সন্তানকে বানায় মা-বাবা’র অবাধ্য ও অপ্রিয়।
ইদানীং প্রতি বছরই দেখা যাচ্ছে থার্টি ফার্স্ট নাইট উদযাপন করতে তরুণ-তরুণীরা অধিক সংখ্যায় রাস্তায় বেরুবার সুযোগ পাচ্ছে। ভাবতে অবাক লাগে নিজেদের কলিজার টুকরো মেয়েটিকে পর্যন্ত আমরা মধ্য রাতে পথে-হোটেলে যাবার সুযোগ দেই? এই যে শত শত তরুণী দুপুর রাতে রাস্তায় বেরিয়ে আসছেন, এরা সবাই কি অভিভাবকহীন? নাকি এদের অভিভাবকরা সন্তানদের বল্গাহীন জীবনকে সাদরে মেনে নিয়েছেন?
মনে রাখা উচিৎ আমাদের একটু অসর্তকতার জন্য যদি সন্তানরা বিপথগামী হবার সুযোগ পায়। তবে এর ক্ষতির প্রথম শিকার হতে হবে আমাকেই। সমাজে মাথা নিচু হবে আমারই। আপন ঔরসজাত সন্তানের জন্য মানুষের কটু-কাটব্যও হজম করতে হবে কেবল আমাকে। তাছাড়া মরণের পরেও এর জন্য ক্ষতি পোহাতে হবে। আবদুল্লাহ ইবন উমার রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«كُلُّكُمْ رَاعٍ، وَكُلُّكُمْ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، الإِمَامُ رَاعٍ وَمَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، وَالرَّجُلُ رَاعٍ فِي أَهْلِهِ وَهُوَ مَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، وَالمَرْأَةُ رَاعِيَةٌ فِي بَيْتِ زَوْجِهَا وَمَسْئُولَةٌ عَنْ رَعِيَّتِهَا، وَالخَادِمُ رَاعٍ فِي مَالِ سَيِّدِهِ وَمَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ، وَكُلُّكُمْ رَاعٍ وَمَسْئُولٌ عَنْ رَعِيَّتِهِ»
“তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল আর সবাই তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে। ইমাম একজন দায়িত্বশীল, তিনি তাঁর দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবেন। পুরুষ দায়িত্বশীল তার পরিবারের, সে জিজ্ঞাসিত হবে তার দায়িত্ব সম্পর্কে। মহিলা দায়িত্বশীল তার স্বামীর গৃহের, সে জিজ্ঞাসিত হবে তার দায়িত্ব সম্পর্কে। ভৃত্যও একজন দায়িত্বশীল, সে জিজ্ঞাসিত হবে তার মুনিবের সম্পদ সম্পর্কে। (এককথায়) তোমরা সবাই দায়িত্বশীল আর সবাই জিজ্ঞাসিত হবে সে দায়িত্ব সম্পর্কে।”[৩]
অতএব আমাদের যুবসম্প্রদায়কে যেমন সংযত হতে হবে, তেমনি অভিভাবকদেরও একটু সজাগ হতে হবে। আল্লাহ আমাদের সকলকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমীন।
লেখক: আলী হাসান তৈয়ব
সম্পাদনা: প্রফেসর ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া