আল্লাহ তা‘আলার হক (পর্ব ২)
তৃতীয় অধিকার : আল্লাহ তা‘আলার আদেশসমূহ পালন করা ও নিষোধাবলি পরিহার করা:
বান্দার ওপর আল্লাহ তা‘আলার সবচেয়ে বড় হক হলো, তার আদেশ বাস্তবায়ন ও নিষেধ পরিহার করার মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার অর্থবহ আনুগত্য করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ أَطِيعُواْ ٱللَّهَ وَأَطِيعُواْ ٱلرَّسُولَ وَلَا تُبۡطِلُوٓاْ أَعۡمَٰلَكُمۡ ٣٣﴾ [محمد: ٣٣]
“হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের আনুগত্য কর এবং নিজেদের কর্ম বিনষ্ট করো না।” [সূরা মুহাম্মাদ: ৩৩]
আল্লাহ আরো বলেন,
﴿وَٱتَّقُواْ ٱلنَّارَ ٱلَّتِيٓ أُعِدَّتۡ لِلۡكَٰفِرِينَ ١٣١ وَأَطِيعُواْ ٱللَّهَ وَٱلرَّسُولَ لَعَلَّكُمۡ تُرۡحَمُونَ ١٣٢﴾ [ال عمران: ١٣١، ١٣٢]
“এবং তোমরা সে আগুন থেকে বেঁচে থাক, যা কাফিরদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। আর তোমরা আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর, যাতে তোমাদের ওপর রহমত নাযিল করা হয়।” [সূরা আলে ইমরান: ১৩১-১৩২]
তিনি আরো বলেন,
﴿قُلۡ أَطِيعُواْ ٱللَّهَ وَٱلرَّسُولَۖ فَإِن تَوَلَّوۡاْ فَإِنَّ ٱللَّهَ لَا يُحِبُّ ٱلۡكَٰفِرِينَ ٣٢﴾ [ال عمران: ٣٢]
“বলুন, আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের আনুগত্য কর। বস্তুত যদি তারা বিমুখতা অবলম্বন করে, তাহলে আল্লাহ তা‘আলা কাফিরদেরকে ভালোবাসেন না।” [সূরা আলে ইমরান: ৩২]
অন্যত্র আরো বলেন,
﴿وَأَطِيعُواْ ٱللَّهَ وَأَطِيعُواْ ٱلرَّسُولَ وَٱحۡذَرُواْۚ فَإِن تَوَلَّيۡتُمۡ فَٱعۡلَمُوٓاْ أَنَّمَا عَلَىٰ رَسُولِنَا ٱلۡبَلَٰغُ ٱلۡمُبِينُ ٩٢﴾ [المائدة: ٩٢]
“তোমরা আল্লাহ তা‘আলা ও রাসূলের অনুগত হও এবং আত্মরক্ষা কর। কিন্তু যদি তোমরা বিমুখ হও তবে জেনে রাখ, আমার রাসূলের দায়িত্ব প্রকাশ্য প্রচার বৈ নয়।” [সূরা আল-মায়েদাহ: ৯২]
আল্লাহ আরো বলেন,
﴿وَمَن يُطِعِ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ يُدۡخِلۡهُ جَنَّٰتٖ تَجۡرِي مِن تَحۡتِهَا ٱلۡأَنۡهَٰرُۖ وَمَن يَتَوَلَّ يُعَذِّبۡهُ عَذَابًا أَلِيمٗا﴾ [الفتح: ١٧]
“যে আল্লাহ তা‘আলা ও তার রাসূলের আনুগত্য করবে তাকে তিনি জান্নাতে দাখিল করবেন, যার তলদেশে নদী প্রবাহিত হয়। পক্ষান্তরে যে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করবে তাকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দিবেন।” [সূরা আল-ফতাহ: ১৭]
আল্লাহ আরো বলেন,
﴿وَمَا كَانَ لِمُؤۡمِنٖ وَلَا مُؤۡمِنَةٍ إِذَا قَضَى ٱللَّهُ وَرَسُولُهُۥٓ أَمۡرًا أَن يَكُونَ لَهُمُ ٱلۡخِيَرَةُ مِنۡ أَمۡرِهِمۡۗ وَمَن يَعۡصِ ٱللَّهَ وَرَسُولَهُۥ فَقَدۡ ضَلَّ ضَلَٰلٗا مُّبِينٗا ٣٦﴾ [الاحزاب: ٣٦]
“আল্লাহ তা‘আলা ও তার রাসূল কোনো কাজের আদেশ করলে কোনো ঈমানদার পুরুষ ও নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন ক্ষমতা নেই। যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূলের আদেশ অমান্য করে সে প্রকাশ্য পথভ্রষ্টতায় পতিত হয়।” [সূরা আল-আহযাব: ৩৬]
হে মুসলিম সম্প্রদায়, আমাদের সকলের জন্য একান্ত জরুরী আগ্রহভরে ও যত্নসহকারে আল্লাহ তা‘আলার এ সমস্ত হক আদায় করা। যাতে আমাদের ভিতর প্রকৃত মুমিনের গুণাবলী বদ্ধমূল হয়। যাদের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَقَالُواْ سَمِعۡنَا وَأَطَعۡنَاۖ غُفۡرَانَكَ رَبَّنَا وَإِلَيۡكَ ٱلۡمَصِيرُ﴾ [البقرة: ٢٨٥]
“তারা বলে, আমরা শুনেছি এবং কবুল করেছি। আমরা তোমার ক্ষমা চাই, হে আমাদের রব। তোমারই দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে।” [সূরা আল-বাকারাহ: ২৮৫]
চতুর্থ অধিকার : আল্লাহ তা‘আলাকে সম্মানপ্রদর্শন ও তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা:
বান্দার পক্ষ থেকে আল্লাহ তা‘আলার অন্যতম প্রাপ্য অধিকার সম্মান, শ্রদ্ধা ও মর্যাদা, যা কয়েকভাবে প্রদান করা যায়।
১. আল্লাহ তা‘আলাকে দোষ-ত্রুটিমুক্ত বলে বিশ্বাস করা। মর্যাদাপূর্ণ ও পরিপূর্ণ গুণে গুণান্বিত মনে করা। যেভাবে তিনি নিজেকে কুরআনে গুণান্বিত করেছেন অথবা যেভাবে তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীসে সম্বোধন করেছেন।
২. তার আদেশ ও নিষেধাবলীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা। তার বর্ণিত সীমারেখার ভিতর স্বীয় জীবন পরিচালনা করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَن يُعَظِّمۡ حُرُمَٰتِ ٱللَّهِ فَهُوَ خَيۡرٞ لَّهُۥ عِندَ رَبِّهِۦ﴾ [الحج: ٣٠]
“আর কেউ আল্লাহ তা‘আলার সম্মানযোগ্য বিধানাবলির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করল, রবের নিকট তা তার জন্যে উত্তম।” [সূরা আল-হাজ্জ: ৩০]
আল্লাহ আরো বলেন,
﴿ذَٰلِكَۖ وَمَن يُعَظِّمۡ شَعَٰٓئِرَ ٱللَّهِ فَإِنَّهَا مِن تَقۡوَى ٱلۡقُلُوبِ ٣٢﴾ [الحج: ٣٢]
“আর যে আল্লাহ তা‘আলার নামযুক্ত বস্তুসমূহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করল, তা তো তার হৃদয়ের আল্লাহভীতি প্রসূত।” [সূরা আল-হাজ্জ: ৩২]
আল্লাহ তা‘আলাকে সম্মান প্রদর্শন করা, তাঁর নিদর্শনাবলির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা এবং তার বর্ণিত সীমারেখার ভিতর জীবন পরিচালনা করাই অনুসরণীয় অগ্র-পথিক সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈন, তাবে তাবেঈন এবং তাদের পরবর্তী নেককার লোকদের আদর্শ ছিল।
পঞ্চম অধিকার : আল্লাহ তা‘আলাকে মহব্বত করা, তাঁর নিকট আশা করা এবং তাকে ভয় করা:
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদেরকে ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। আল-কুরআনে বর্ণিত হচ্ছে,
﴿وَمَا خَلَقۡتُ ٱلۡجِنَّ وَٱلۡإِنسَ إِلَّا لِيَعۡبُدُونِ ٥٦ مَآ أُرِيدُ مِنۡهُم مِّن رِّزۡقٖ وَمَآ أُرِيدُ أَن يُطۡعِمُونِ ٥٧ إِنَّ ٱللَّهَ هُوَ ٱلرَّزَّاقُ ذُو ٱلۡقُوَّةِ ٱلۡمَتِينُ ٥٨﴾ [الذاريات: ٥٦، ٥٨]
“আমি জিন্ন এবং ইনসানকে সৃষ্টি করেছে একমাত্র আমার ইবাদত করার জন্যে। আমি তাদের কাছে জীবিকা চাই না এবং এও চাই না যে, তারা আমাকে আহার্য জোগাবে। আল্লাহ তা‘আলাই তো জীবিকা শক্তির আধার, পরাক্রান্ত।” [সূরা আয-যারিয়াত: ৫৬-৫৮]
বর্ণিত তিনটি মূল ভিত্তির ওপর আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত নির্ভরশীল। অর্থাৎ ১. মহব্বত ২. আশা ও ৩. ভয়।
ষষ্ঠ অধিকার : নি‘আমতের মোকাবেলায় তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা:
আল্লাহ তা‘আলার অগণিত ও অসংখ্য নি‘আমত নিরবচ্ছিন্নভাবে তার বান্দার ওপর বর্ষিত হচ্ছে; যেমন, সৃষ্টির নি‘আমত, ধন-সম্পদের নি‘আমত, ইসলামের নি‘আমত, পানির নি‘আমত, বাতাসের নি‘আমত, বিবেক, শরীর, স্ত্রী ও সন্তানদের সুস্থতার নি‘আমত। তাই বান্দাদের উচিৎ এ নি‘আমতের শুকরিয়া আদায় করা, যা তিনটি পদ্ধতি অনুসরণ করলে সুচারুরূপে আদায় করা যায়।
১. নি‘আমতের স্বীকারোক্তি প্রদানমূলক কৃতজ্ঞতাসহ তা গ্রহণ করা। অর্থাৎ বান্দা একনিষ্ঠ ও আন্তরিকভাবে স্বীকার করবে যে, আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় দয়া ও মেহেরবাণীতে এ নি‘আমত দান করেছেন। আল-কুরআনে বর্ণিত হচ্ছে,
﴿وَمَا بِكُم مِّن نِّعۡمَةٖ فَمِنَ ٱللَّهِۖ ثُمَّ إِذَا مَسَّكُمُ ٱلضُّرُّ فَإِلَيۡهِ تَجَۡٔرُونَ ٥٣﴾ [النحل: ٥٣]
“তোমাদের কাছে যে সমস্ত নি‘আমত আছে তা আল্লাহরই পক্ষ থেকে।” [সূরা আন-নাহল: ৫৩]
সুতরাং স্বীয় প্রয়োজন, চাহিদা ও অভাববোধসহ আগ্রহভরে আল্লাহর নি‘আমত গ্রহণ করা এবং এর থেকে উপকৃত হওয়া।
২. দান-সাদাকাহ, পোশাক-আশাক ও বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার নি‘আমতের বহিঃপ্রকাশ করা এবং তাঁর প্রশংসা। অর্থাৎ বান্দা আল্লাহ তা‘আলার নি‘আমতের আলোচনা করবে। তার দয়ার প্রতিফলন এ নি‘আমতরাজি -সর্বদা মনে করবে। আল-কুরআনে বর্ণিত হচ্ছে,
﴿وَأَمَّا بِنِعۡمَةِ رَبِّكَ فَحَدِّثۡ ١١﴾ [الضحى: ١١]
“আর আপনার রবের নি‘আমতের কথা প্রকাশ করুন।” [সূরা আদ-দ্বুহা: ১১]
আরো মনে-প্রাণে বিশ্বাস রাখবে আল্লাহ তা‘আলা দানশীল, অনুগ্রহকারী, রহমশীল ও দয়ালু।
৩. আল্লাহ তা‘আলার পছন্দনীয় জায়গায় নি‘আমত ব্যবহার করবে। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশিত জায়গায় নি‘আমতের ব্যবহার সুবর্ণ সুযোগ মনে করবে। শরী‘আত নিষিদ্ধ জায়গায় অপচয় করা থেকে বিরত থাকবে। কারণ, এটা নাফরমানী ও অকৃতজ্ঞতা, যা শরী‘আত কিংবা বিবেক দ্বারা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।
সপ্তম অধিকার: তাকদীরকে মেনে নেওয়া এবং তার ওপর সন্তুষ্ট থাকা:
আল্লাহ তা‘আলা কতিপয় বান্দাদের মুসীবতের মাধ্যমে অথবা নি‘আমতের মাধ্যমে কিংবা উভয়ের মাধ্যমে পরীক্ষা করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلَنَبۡلُوَنَّكُمۡ حَتَّىٰ نَعۡلَمَ ٱلۡمُجَٰهِدِينَ مِنكُمۡ وَٱلصَّٰبِرِينَ وَنَبۡلُوَاْ أَخۡبَارَكُمۡ ٣١﴾ [محمد: ٣١]
“আমরা অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব যে পর্যন্ত না ফুটিয়ে তুলি তোমাদের জিহাদকারীদের এবং সবরকারীদের এবং যতক্ষণ না আমরা তোমাদের অবস্থানসমূহ যাচাই করি।” [সূরা মুহাম্মাদ: ৩১]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿وَلَنَبۡلُوَنَّكُم بِشَيۡءٖ مِّنَ ٱلۡخَوۡفِ وَٱلۡجُوعِ وَنَقۡصٖ مِّنَ ٱلۡأَمۡوَٰلِ وَٱلۡأَنفُسِ وَٱلثَّمَرَٰتِۗ وَبَشِّرِ ٱلصَّٰبِرِينَ ١٥٥﴾ [البقرة: ١٥٥]
“এবং আমরা অবশ্যই তোমাদিগকে পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, মাল ও জানের ক্ষতি এবং ফসলাদি বিনষ্টের মাধ্যমে; তবে সুসংবাদ দাও ধৈর্য্য অবলম্বনকারীদের।” [সূরা আল-বাকারাহ: ১৫৫]
পরীক্ষামূলক এ সমস্ত মুসীবতের মোকাবেলায় বান্দার উচিৎ ধৈর্য্য ধারণ করা ও তাকদীরকে মেনে নেওয়া। যেহেতু আল্লাহ তা‘আলা এ নির্দেশ-ই প্রদান করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱصۡبِرُواْ وَصَابِرُواْ وَرَابِطُواْ﴾ [ال عمران: ٢٠٠]
“হে ইমানদারগণ! তোমরা ধৈর্য্য ধারণ কর এবং মোকাবেলায় দৃঢ়তা অবলম্বন কর।” [সূরা আলে ইমরান: ২০০]
সমাপ্ত
সানাউল্লাহ নজির আহমদ
সম্পাদনা: প্রফেসর ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া