কালেমা শাহাদাত (পর্ব-১)
ইসলামের গোড়া পত্তন হয়েছে শির্কের কলঙ্ক ও পৌত্তলিকতার নোংরামী মুক্ত খাঁটি, নিভের্জাল তাওহীদের ওপর। যার রূপকার لا إله إلا الله ও محمد رسول الله এর শাহাদাত বা সাক্ষ্য প্রদান।
لا إله إلا الله এর শাহাদাতের উদ্দেশ্য:
বিনয়-নম্র ভাবে নিজেকে আল্লাহর সমীপে সঁপে দেওয়া, তার বশ্যতা মেনে নেওয়া। তিনি এক, তার কোনো শরীক নেই, এটা ঘোষণা দেওয়া।
محمد رسول الله এর শাহদাতের উদ্দেশ্য:
নিজেকে সঁপে দেওয়ার পদ্ধতি ও ইবাদতের বিশদ বর্ণনা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট থেকে গ্রহণ করা। উভয় শাহাদাতের মৌখিক উচ্চারণ ইসলাম গ্রহণ ও ইসলামকে আলিঙ্গন করার বহিঃপ্রকাশ।
কিয়ামতের দিন দুইটি প্রশ্নের উত্তর না দেওয়া পর্যন্ত কোনো আদম সন্তান স্বীয় অবস্থান ত্যাগ করতে পারবে না।
প্রথম প্রশ্ন: তোমরা কার ইবাদত করতে?
দ্বিতীয় প্রশ্ন: রাসূল কে কী জাওয়াব দিয়েছ?
প্রথম প্রশ্নের উত্তর: ইলম তথা আল্লাহর পরিচয় লাভ, মৌখিক স্বীকৃতি প্রদান এবং আমলের মাধ্যমে لا إله إلا الله এর বাস্তবায়ন।
দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর: ইলম তথা রসূল সা. এর পরিচয় লাভ, মৌখিক স্বীকৃতি প্রদান এবং আনুগত্যের মাধ্যমে محمد رسول الله এর বাস্তবায়ন।
لا إله إلا الله এর সাক্ষ্য প্রদানের তাৎপর্য:
সংবেদনশীল, তাৎপর্যপূর্ণ এ সাক্ষ্য প্রদানের অর্থ হল: ‘সত্যিকারার্থে আল্লাহ ছাড়া কেউ ইবাদতের উপযুক্ত নয়। যেহেতু একমাত্র আল্লাহ তাআলা সৃষ্টিকর্তা, অধিপতি, রিযিকদাতা, কল্যাণ সাধনকারী, ক্ষতিসাধনকারী ও পরিচালনাকারী, সেহেতু আল্লাহ তাআলার বান্দা স্বীয় নিবেদন, আশা, ভয়, মহব্বত, মীমাংসা, ভরসা এবং সমস্ত কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে একমাত্র তাঁর শরণাপন্ন হবে, অন্য কারো নয়।
শাহাদাতের মূল ভিত্তি:
শাহাদাত বা لا إله إلا الله এর সাক্ষ্য মূল দুইটি ভিত্তির উপর নির্ভরশীল-
১. প্রত্যাখ্যান।
২. স্বীকৃতি প্রদান।
لا إله : প্রত্যাখ্যান। অর্থাৎ ইবাদতের উপযুক্ত যে কোনো উপাস্যের অস্তিত্বকে প্রত্যাখ্যান করা, একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত।
إلا الله : স্বীকৃতি প্রদান। একমাত্র আল্লাহ তাআলাই ইবাদতের উপযুক্ত অন্য কেউ নয়, এর স্বীকৃতি প্রদান করা।
لاإله إلا الله এর শর্তসমূহ :
আলোচিত কালেমায়ে তাওহীদ জান্নাতে প্রবেশের চাবিস্বরূপ, জাহান্নাম তাতে মুক্তির ঢালস্বরূপ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«من مات وهو يعلم أن لاإله إلا الله دخل الجنة».
“যে لاإله إلا الله (অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কোনো মা‘বূদ নেই) এর অর্থ, তাৎপর্যের জ্ঞান নিয়ে মারা গেল সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’’
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন,
«إن الله حرم على النار من قال لاإله إلا الله يبتغي بذلك وجه الله».
“অবশ্যই আল্লাহ তাআলা ঐ ব্যক্তির উপর জাহান্নাম হারাম করে দিয়েছেন, যে আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যে لاإله إلا الله কালিমাটি পাঠ করেছে।’’
আফসোস! অনেক মানুষ কালেমায়ে শাহাদাত শুধু মুখে উচ্চারণ করে পরমানন্দে নিশ্চিন্ত বসে আছে, অথচ এর শর্ত, এর দাবী বাস্তবায়ন যে কত অপরিহার্য তা একেবারে বেমালুম ভুলে আছে। ওহাব ইবন মুনাব্বিহ রহ.-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল,
«أليس لاإله إلا الله مفتاح الجنة؟ قال: بلى، ولكن ما من مفتاح إلا وله أسنان، فإن جئت بمفتاح له أسنان فتح لك، وإلا لن يفتح لك».
لاإله إلا الله কি জান্নাতের চাবি নয়? তিনি উত্তর দিলেন: অবশ্যই। তবে প্রতিটি চাবির কিন্তু দাঁত থাকে। যদি তুমি দাঁত আছে এমন চাবি নিয়ে আস, তোমাকে দরজা খুলে দেওয়া হবে। অন্যথায় দরজা খুলে দেওয়া হবে না।
কতক প্রজ্ঞাময় ওলামায়ে কেরাম নিম্নের পংক্তির মাধ্যমে لاإله إلا الله এর শর্তগুলো একত্রিত করে বর্ণনা করে দিয়েছেন:
علم يقين وإخلاص وصدقك * محبة وانقياد والقبول لها
وزيد ثامنها الكفران منك بما * سوى الإله من الأوثان قد ألها
১. ইলম।
২. দূঢ় বিশ্বাস।
৩. ইখলাস।
৪. সততা, আন্তরিকতা।
৫. ভালোবাসা।
৬. আত্মসমর্পণ।
৭. لاإله إلا الله কে মনে প্রাণে গ্রহণ করা।
৮. আল্লাহর বিপরীতে উপাস্য সকল মূর্তি পত্যাখ্যান করা।
আটটি মূল ভিত্তির ওপর সামান্য আলোকপাত :
১. এই কালেমার অর্থ, আবেদন ও দাবী সর্ম্পকে জ্ঞান অর্জন করা, অজ্ঞতা পরিহার করা:
বান্দাকে অবশ্যই জানতে হবে لاإله إلا الله (প্রত্যাখ্যান ও গ্রহণ) অস্বীকৃতি ও স্বীকৃতি দুইটি বিষয়ের সমন্বয়। এই কালিমার দাবি হচ্ছে: আল্লাহ ছাড়া যে কোনো জিনিসের ইবাদতের উপযুক্ততা প্রত্যাখ্যান করা এবং একমাত্র আল্লাহ তায়ালার জন্য স্বীকৃতি প্রদান করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿فَٱعۡلَمۡ أَنَّهُۥ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا ٱللَّهُ﴾ [محمد: ١٩]
“জেনে রাখুন, আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই।” [সূরা মুহাম্মাদ: ১৯] রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«من مات وهو يعلم أن لا إله إلا الله دخل الجنة».
“যে ব্যক্তি لاإله إلا الله এর তাৎপর্য ও অর্থ জানাবস্থায় মারা গেল, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’
২. এই কালেমার উপর দৃঢ় বিশ্বাস রাখা, সংশয়-সন্দেহ পরিত্যাগ করা:
لاإله إلا الله এর অর্থ ও তাৎপর্যকে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করার মানে, এর ব্যাপারে কোনো ধরনের সংশয়, সন্দেহ বা কিংকর্তব্যবিমূঢ়তার বিন্দুমাত্র সংমিশ্রন থাকতে পারবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿إِنَّمَا ٱلۡمُؤۡمِنُونَ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ بِٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦ ثُمَّ لَمۡ يَرۡتَابُواْ وَجَٰهَدُواْ بِأَمۡوَٰلِهِمۡ وَأَنفُسِهِمۡ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِۚ أُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلصَّٰدِقُونَ ١٥﴾ [الحجرات: ١٥]
“তারাই মুমিন, যারা আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি ঈমান আনার পর সন্দেহ পোষণ করে না এবং আল্লাহর রাস্তায় ধন-সম্পদ ও জীবন দ্বারা জিহাদ করে। তারাই সত্যনিষ্ঠ।” [সূরা আল-হুজুরাত: ১৫]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবূ হুরায়রাকে বলেন,
«يا أبا هريرة اذهب بنعلي هاتين- وأعطاه نعليه- فمن لقيت من وراء هذاالحائط يشهد أن لا إله إلا الله مستيقنا بها قلبه فبشره بالجنة».
“হে আবূ হুরায়রা! তুমি আমার এ দু’টি জুতা নিয়ে যাও (তাকে জুতা দু’টি প্রদান করলেন) এ দেওয়ালের ওপাশে অন্তরের অন্তস্থল থেকে দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে لاإله إلا الله এর সাক্ষ্য প্রদানকারী যার সাথেই তুমি সাক্ষাত করবে তাকে জান্নাতের সুসংবাদ দাও।”
৩. এই কালেমার আবেদন ও দাবী স্বতঃস্ফুর্ত গ্রহণ করা, প্রত্যাখ্যান না করা:
অন্তর ও অঙ্গ-প্রতঙ্গের মাধ্যমে এই কালেমার আবেদন সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করা। যে ব্যক্তি এই কালেমার আবেদনকে প্রত্যাখ্যান করবে, আন্তরিকভাবে মেনে না নিবে সে কাফির। সাধারণত প্রত্যাখ্যান করা হয়ে থাকে অহংকার, বিরোধিতা, হিংসা, বাপ-দাদার অন্ধানুকরণ ইত্যাদি কারণে। যেমন, পবিত্র কুরআনের ভাষায় অহংকারবশতঃ لاإله إلا الله এর অর্থ ও তাৎপর্যকে প্রত্যাখ্যানকারী কাফিরদের ঔদ্ধত্য প্রকাশের কারণে হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿إِنَّهُمۡ كَانُوٓاْ إِذَا قِيلَ لَهُمۡ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا ٱللَّهُ يَسۡتَكۡبِرُونَ ٣٥ وَيَقُولُونَ أَئِنَّا لَتَارِكُوٓاْ ءَالِهَتِنَا لِشَاعِرٖ مَّجۡنُونِۢ ٣٦ ﴾ [الصافات: ٣٥، ٣٦]
“তাদের যখন বলা হত আল্লাহ ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই, তখন তারা ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করত এবং বলত, আমরা কি এক উন্মাদ কবির কথায় আমাদের উপাস্যদের পরিত্যাগ করব?’’ [সূরা আস-সাফফাত: ৩৫-৩৬]
অতীত উম্মতের ভিতর যারা এই কালেমার আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেছে, আন্তরিকভাবে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে, তাদের থেকে নেওয়া প্রতিশোধ চিত্র পবিত্র কুরআনে তুলে ধরা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَكَذَٰلِكَ مَآ أَرۡسَلۡنَا مِن قَبۡلِكَ فِي قَرۡيَةٖ مِّن نَّذِيرٍ إِلَّا قَالَ مُتۡرَفُوهَآ إِنَّا وَجَدۡنَآ ءَابَآءَنَا عَلَىٰٓ أُمَّةٖ وَإِنَّا عَلَىٰٓ ءَاثَٰرِهِم مُّقۡتَدُونَ ٢٣ ۞قَٰلَ أَوَلَوۡ جِئۡتُكُم بِأَهۡدَىٰ مِمَّا وَجَدتُّمۡ عَلَيۡهِ ءَابَآءَكُمۡۖ قَالُوٓاْ إِنَّا بِمَآ أُرۡسِلۡتُم بِهِۦ كَٰفِرُونَ ٢٤ فَٱنتَقَمۡنَا مِنۡهُمۡۖ فَٱنظُرۡ كَيۡفَ كَانَ عَٰقِبَةُ ٱلۡمُكَذِّبِينَ ٢٥ ﴾ [الزخرف: ٢٣، ٢٥]
“এমনিভাবে আপনার পূর্বে আমি যখন কোনো জনপদে কোনো সতর্ককারী প্রেরণ করেছি, তখন তাদেরই বিত্তশালীরা বলেছে, আমরা আমাদের বাপ-দাদাদের পেয়েছি এক পথের পথিক এবং আমরা তাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলি। সে বলত, তোমরা তোমাদের পূর্বপুরুষদেরকে যে বিষয়ের ওপর পেয়েছ, আমি যদি তদপেক্ষা উত্তম বিষয় নিয়ে তোমাদের কাছে এসে থাকি, তবুও কি তোমরা তাই বলবে, তারা বলত তোমরা যে বিষয়সহ প্রেরিত হয়েছ, তা আমরা মানব না। ফলে আমি তাদের থেকে প্রতিশোধ নিয়েছি। অতঃপর দেখুন, মিথ্যারোপকারীদের পরিণাম কিরূপ হয়েছে।” [সূরা আয-যুখরুফ: ২৩-২৫]
৪. এই কালেমার প্রতি সম্পূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ করা, পরিত্যক্ত করে না রাখা:
বাহ্যিক অঙ্গ-প্রতঙ্গ, আভ্যন্তরিণ মননশীলতার মাধ্যমে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এই কালেমার অর্থ, আবেদন ও তাৎপর্যকে সম্পূর্ণরূপে মেনে নেওয়া। যার সত্যতা প্রমাণিত হবে, আল্লাহ তাআলার আদেশ বাস্তবায়ন, তার পছন্দনীয় বস্তুগুলো গ্রহণ, অপছন্দনীয় বস্তুগুলো বর্জন এবং তার গোস্বা ও রাগান্বিত বিষয়-বস্তুগুলো পরিহার করার মাধ্যমে। আল্লাহ বলেন,
﴿وَمَن يُسۡلِمۡ وَجۡهَهُۥٓ إِلَى ٱللَّهِ وَهُوَ مُحۡسِنٞ فَقَدِ ٱسۡتَمۡسَكَ بِٱلۡعُرۡوَةِ ٱلۡوُثۡقَىٰۗ وَإِلَى ٱللَّهِ عَٰقِبَةُ ٱلۡأُمُورِ ٢٢ وَمَن كَفَرَ فَلَا يَحۡزُنكَ كُفۡرُهُۥٓۚ﴾ [لقمان: ٢٢، ٢٣]
“যে ব্যক্তি সৎকর্ম পরায়ন হয়ে আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পন করে, সে দৃঢ়ভাবে ধারণ করে এক মজবুত হাতল। যাবতীয় কাজের পরিণাম আল্লাহর ইখতিয়ারে। যে ব্যক্তি কুফুরী করে, তার কুফুরী যেন আপনাকে ক্লিষ্ট না করে।” [সূরা লুকমান: ২২-২৩] অন্যত্র আল্লাহ বলেন,
﴿فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤۡمِنُونَ حَتَّىٰ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيۡنَهُمۡ ثُمَّ لَا يَجِدُواْ فِيٓ أَنفُسِهِمۡ حَرَجٗا مِّمَّا قَضَيۡتَ وَيُسَلِّمُواْ تَسۡلِيمٗا ٦٥ ﴾ [النساء: ٦٥]
“অতএব, তোমার রবের শপথ! তারা কখনো ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে বিচারক বলে মেনে না নেয়, তৎপর তুমি যে বিচার করবে তা দ্বিধাহীন অন্তরে গ্রহণ না করে।” [সূরা আন-নিসা: ৬৫]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«لايؤمن أحدكم حتى يكون هواه تبعا لما جئت به».
“তোমাদের কেউ মুমিন বলে গণ্য হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত আমার আনীত বিধানের প্রতি তার প্রবৃত্তি আনুগত্য প্রকাশ না করবে।’ [ইমাম নাওয়াবী কর্তৃক আরবা‘ঈন গ্রন্থে বর্ণিত]
৫. এই কালেমার ব্যাপারে নিরেট সততা প্রর্দশন করা, মিথ্যা ও কপটতা পরিহার করা :
বান্দার অন্তরে সুপ্ত অভিব্যক্তির সাথে মুখের উচ্চারণের এতটুকু সমন্বয় থাকতে হবে, যার দ্বারা তার অবস্থা মুনাফিক তথা কপটদের অবস্থা থেকে সম্পূর্ণ পৃথক হয়ে যায়- যারা মিথ্যা ও ধোকার আশ্রয় নিয়ে মুখে এমন সব কথা উচ্চারণ করে যা তাদের অন্তরে বিদ্যমান থাকে না। আল্লাহ বলেন,
﴿وَمِنَ ٱلنَّاسِ مَن يَقُولُ ءَامَنَّا بِٱللَّهِ وَبِٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِ وَمَا هُم بِمُؤۡمِنِينَ ٨ يُخَٰدِعُونَ ٱللَّهَ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَمَا يَخۡدَعُونَ إِلَّآ أَنفُسَهُمۡ وَمَا يَشۡعُرُونَ ٩ فِي قُلُوبِهِم مَّرَضٞ فَزَادَهُمُ ٱللَّهُ مَرَضٗاۖ وَلَهُمۡ عَذَابٌ أَلِيمُۢ بِمَا كَانُواْ يَكۡذِبُونَ ١٠﴾ [البقرة: ٨، ١٠]
“আর মানুষের মধ্যে কিছু লোক এমন রয়েছে যারা বলে, আমরা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান এনেছি অথচ তারা আদৌ ঈমানদার নয়। তারা আল্লাহ এবং ঈমানদারগণকে ধোঁকা দেয়। অথচ এর দ্বারা নিজেদেরকে ছাড়া অন্য কাউকে ধোঁকা দেয় না। অথচ তারা তা অনুভব করতে পারে না। তাদের অন্তকরণ ব্যধিগ্রস্ত আর আল্লাহ তাদের ব্যধি আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন। বস্তুত তাদের জন্য নির্ধারিত রয়েছে ভয়াবহ আযাব, তাদের মিথ্যাচারের দরুন।” [সূরা আল-বাকারাহ: ৮-১০]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«ما من أحد يشهد ألا إله إلا الله صدقا من قلبه إلا حرمه الله على النار».
“যে ব্যক্তি আন্তরিকভাবেلاإله إلا الله এর সাক্ষ্য প্রদান করবে তার ওপর আল্লাহ তা‘আলা জাহান্নাম হারাম করে দিবেন।”
৬. এই কালেমার প্রতি খাঁটি মহববত প্রদর্শন করা, বিদ্বেষ পোষণ না করা :
এই কালিমা ও তার আবেদনের প্রতি অগাধ ভালবাসা ও মহব্বত রাখা। অর্থাৎ এই কালেমা অনুযায়ী আমল পছন্দ করা, যারা এর ওপর আমল করে এবং এর প্রতি আহ্বান করে তাদের মহব্বত করা। যারা এই কালেমাকে অপছন্দ করে এর সাথে প্রতারণা বা মিথ্যারোপ করে, এর থেকে পৃষ্ঠপ্রর্দশন করে ও এর প্রচার প্রসারকে বাধাগ্রস্ত করে, তাদেরকে অপছন্দ ও প্রতিহত করা। এই কালেমার প্রতি মহব্বতের প্রমাণ দেওয়ার জন্য আরো প্রয়োজন- আল্লাহ তাআলার আদেশকৃত ও পছন্দনীয় জিনিসগুলো মেনে নেওয়া, যদিও তা প্রবৃত্তির বিপরীত হয়। অপরপক্ষে আল্লাহ তাআলার নিষেধকৃত ও অপছন্দনীয় জিনিসগুলোর প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা, তা থেকে দূরে থাকা, যদিও তার প্রতি অন্তর ধাবিত হয়। আল্লাহর বান্দাদের সাথে সর্ম্পক স্থাপন করা। আল্লাহর শত্রুদের সাথে সর্ম্পকচ্ছেদ করা। রাসূলের অনুসেরন অনুকরণ করা। তার দিক নির্দেশনার অনুসরণ করা। তার আনীত বিধানকে কবুল করা। এ ছাড়া মহব্বত শুধু একটি দাবী যার কোনো বাস্তবতা নেই। আল্লাহ বলেন,
﴿وَمِنَ ٱلنَّاسِ مَن يَتَّخِذُ مِن دُونِ ٱللَّهِ أَندَادٗا يُحِبُّونَهُمۡ كَحُبِّ ٱللَّهِۖ وَٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ أَشَدُّ حُبّٗا لِّلَّهِۗ﴾ [البقرة: ١٦٥]
“আর কোনো লোক এমন রয়েছে যারা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কিছুকে আল্লাহর সমকক্ষ সাব্যস্ত করে এবং এদের প্রতি এমন ভালোবাসা পোষণ করে যেমন আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা হয়ে থাকে। কিন্তু যারা আল্লাহর প্রতি ঈমানদার তাদের ভালোবাসা এদের তুলনায় বহুগুণ বেশি।” [সূরা আল-বাকারাহ: ১৬৫]
অর্থাৎ কালেমায়ে তাওহীদ তাদের অন্তরে ও হৃদয়ে স্থায়ীরূপ নিয়েছে। তাদের অন্তর ও হৃদয় এ কালেমা পরিপূর্ণ করে দিয়েছে, বিধায় অন্য কোনো জিনিসের জন্য তাদের অন্তর উন্মুক্ত হয় না। তাদের অন্তরে যত মহব্বত-বিদ্বেষ দেখা যায় সব এই কালেমার অনুকরণে উৎসারিত হয়।
৭. এই কালেমার প্রতি পূর্ণ ইখলাস প্রদর্শন করা, লৌকিকতা, সুখ্যাতি ও অংশিদারিত্ব পরিহার করা :
সমস্ত ইবাদতে একমাত্র আল্লাহর প্রতি নিবিষ্ট চিত্তে মনোনিবেশন করা। ছোট বড় সমস্ত শির্ক থেকে নিয়ত পরিশুদ্ধ রাখা। আল্লাহ বলেন,
﴿وَمَآ أُمِرُوٓاْ إِلَّا لِيَعۡبُدُواْ ٱللَّهَ مُخۡلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ حُنَفَآءَ وَيُقِيمُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَيُؤۡتُواْ ٱلزَّكَوٰةَۚ وَذَٰلِكَ دِينُ ٱلۡقَيِّمَةِ ٥ ﴾ [البينة: ٥]
“তাদেরকে এ ছাড়া কোনো নির্দেশ করা হয় নি যে, তারা খাঁটি মনে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত করবে, সালাত কায়েম করবে এবং যাকাত দিবে। এটাই সঠিক দীন।” [সূরা আল-বায়্যিনাহ: ৫]
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«إن الله حرم على النار من قال لاإله إلا الله يبتغي بذلك وجه الله عز وجل».
“আল্লাহ তা‘আলা ঐ ব্যক্তির ওপর জাহান্নাম হারাম করে দিয়েছেন যে, আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য لاإله إلا الله বলেছে।”
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«قلت يارسول الله من أسعد الناس لشفاعتك يوم القيامة؟ فقال: لقد ظننت يا أباهريرة أن لايسألني عن هذا أحد أول منك لما رأيت من حرصك على الحديث. أسعد الناس بشفاعتي يوم القيامة من قال لاإله إلا الله خالصا من قبل نفسه».
“আমি বলেছি হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিয়ামতের দিন আপনার সুপারিশের মাধ্যমে কে সবচেয়ে বেশি সৌভাগ্যবান হবে? তিনি বললেন : হে আবু হুরায়রা, আমি নিশ্চিতভাবে ধারণা করেছিলাম যে, এ ব্যাপারে তোমার আগে কেউ আমাকে জিজ্ঞাসা করবে না। যেহেতু হাদীসের প্রতি তোমার অধিক আগ্রহ লক্ষ্য করেছি। (শুন!) কিয়ামতের দিন আমার শাফা‘আত বা সুপারিশ দ্বারা ঐ ব্যক্তি বেশি লাভবান হবে যে অন্তরের অন্তস্থল হতে নিবিষ্ট চিত্তে لاإله إلا الله বলেছে।”
সানাউল্লাহ নজির আহমদ
সম্পাদনা: প্রফেসর ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া