bn বাংলা
বাংলা বাংলা
English English
عربي عربي


+8801575-547999
সকাল ৯টা হতে রাত ১০টা
Community Welfare Initiative

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্ম-মৃত্যুর তারিখ সম্পর্কে আলেমদের বিভিন্ন বক্তব্য ও বিশুদ্ধ অভিমত

প্রশ্ন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্ম ও মৃত্যুর তারিখ কোনটি, এ বিষয়ে অনেকগুলো অভিমত আমার সংগ্রহে রয়েছে, বিশুদ্ধ অভিমত কোনটি, কুরআন ও সুন্নাহের আলোকে জানতে চাই?

উত্তর: আল-হামদুলিল্লাহ

প্রথমত: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মের নির্দিষ্ট দিন ও মাস সম্পর্কে ঐতিহাসিকগণ বিভিন্ন মত পেশ করেছেন। এর পশ্চাতে যৌক্তিক কারণও রয়েছে, যেহেতু কারোই জানা ছিল না এ নবজাতকের ভবিষ্যৎ কেমন হবে? তাই সবার নিকট অন্যান্য জন্মের ন্যায় তার জন্ম স্বাভাবিক ও অগুরুত্বপূর্ণ ছিল, এ জন্য কারো পক্ষেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্ম তারিখ নির্দিষ্ট ও চূড়ান্তভাবে জানা সম্ভব হয়নি।

ড. মুহাম্মাদ তাইয়্যেব আন-নাজ্জার রাহিমাহুল্লাহ বলেন, “এর রহস্য সম্ভবত এই যে, যখন তিনি জন্ম গ্রহণ করেন, তখন তার থেকে কেউ এমন বিপদ আশঙ্কা করেনি, আর এ জন্যই জন্মলগ্ন থেকে নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্ব পর্যন্ত বিশ্ববাসীর দৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দুতে তিনি পরিণত হননি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মের চল্লিশ বছর পর যখন আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে রিসালাতের দাওয়াত পৌঁছানোর নির্দেশ প্রদান করেন, তখন থেকেই মানুষ এ নবী সংক্রান্ত তাদের শ্রুত ঘটনাগুলো স্মরণ করা আরম্ভ করে, সম্ভাব্য ও অপরিচিত প্রত্যেক লোকের কাছ থেকেই তার ইতিহাস জানার চেষ্টা করে, এ বিষয়ে তাদেরকে অনেকটা সমৃদ্ধ করেছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিজের বর্ণনা, বুঝ হওয়ার পর থেকে তার ওপর দিয়ে যেসব ঘটনা অতিক্রান্ত হয়েছে, অথবা তিনি যেসব পরিস্থিতি পার করেছেন, অনুরূপ তার সাহাবীগণের বর্ণনা এবং যারা এসব ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত ছিল তাদের বর্ণনা। মুসলিমগণ তাদের নবীর ইতিহাস সংক্রান্ত শ্রুত সব ঘটনা সংগ্রহ করা আরম্ভ করেন, যেন কিয়ামত পর্যন্ত মানুষের জন্য তা বর্ণনা করে যেতে পারেন।”[1]

দ্বিতীয়ত: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মের নির্দিষ্ট বছর ও দিন সম্পর্কে সকলে একমত:

জন্মের নির্দিষ্ট বছর: তার জন্মের নির্দিষ্ট বছর ছিল ‘আমুল ফিল’ তথা হস্তী বাহিনীর বছর। ইমাম ইবনুল কাইয়্যেম রাহিমাহুল্লাহ বলেন, “এতে সন্দেহ নেই যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্ম হয় মক্কার অভ্যন্তরে হস্তী বাহিনীর বছর।”[2]

মুহাম্মাদ ইবন ইউসূফ সালেহী রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, “ইবন ইসহাক রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘তার জন্ম ছিল হস্তি বাহিনীর বছর’। ইবন কাসীর রাহিমাহুল্লাহ বলেন, জমহুরের নিকট এ অভিমতই প্রসিদ্ধ। ইমাম বুখারীর উস্তাদ ইবরাহীম ইবন মুনযির বলেছেন, এ ব্যাপারে কোনো আলেম দ্বিমত পোষণ করেননি। খলিফা ইবন খাইয়াত, ইবনুল জাযযার, ইবন দিহইয়াহ, ইবন জাওযী ও ইবনুল কাইয়্যেম এ মতের ওপর সকলের ঐকমত্য বর্ণনা করেছেন।”[3]

ড. আকরাম দিয়া আল-উমরী বলেন, “সত্য হলো: হস্তী বাহিনীর বিপরীত মতগুলোর প্রত্যেকটি সনদ দুর্বল, যার দ্বারা বুঝে আসে যে, তার জন্ম ছিল হস্তি বাহিনীর দশ বছর অথবা তেইশ বছর অথবা চল্লিশ বছর পর, তবে অধিকাংশ আলেম বলেছেন তার জন্ম হস্তী বাহিনীর বছর। আধুনিক যুগে মুসলিম ও পাশ্চাত্য গবেষকদের পরিচালিত গবেষণা এ মতই সমর্থন করে, তারা বলেছেন হস্তী বাহিনীর বছর ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দ অথবা ৫৭১ খ্রিষ্টাব্দ মোতাবেক ছিল।”[4]

নির্দিষ্ট দিন, সোমবার তিনি জন্ম গ্রহণ করেন, এতে কারো দ্বিমত নেই। এ দিনে তাকে নবুওয়াত প্রদান করা হয়, এ দিনেই তিনি মারা যান।

আবু কাতাদা আনসারী রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

«سئل صلى الله عليه وسلم عن صوم  يوم الاثنين ؟ قال : ذاك يوم ولدت فيه ، ويوم بعثت – أو أنزل علي فيه».

“রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সোমবার দিনের সিয়াম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তিনি বলেন, এ দিনে আমার জন্ম হয়েছে এবং এ দিনেই আমাকে নবুওয়াত প্রদান করা হয়েছে।”[5]

ইবন কাসীর রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, “যারা বলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুমু‘আর দিন রবিউল আউয়াল মাসের সতের তারিখ জন্মেছেন, তাদের কথা সুদূর পরাহত বরং ভুল। জনৈক শি‘আ-এর লিখিত কিতাব ‘ইলামুর রুওয়া বি আলামিল হুদা’ থেকে হাফেয ইবন দিহইয়াহ উপর্যুক্ত মন্তব্য নকল করেন, অতঃপর তিনি এর দুর্বলতা প্রমাণ করেন, এ মতটি আসলেই দুর্বল, কারণ হাদীসের বিপরীত।”[6]

তৃতীয়ত: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মের ব্যাপারে মতবিরোধ হচ্ছে নির্দিষ্ট মাস ও নির্দিষ্ট তারিখ সম্পর্কে, এ বিষয়ে আমরা আলেমদের বিভিন্ন অভিমত জানতে পেরেছি, যেমন,

এক. কেউ বলেছেন: রবিউল আউয়ালের দ্বিতীয় তারিখ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম জন্মেছেন।

ইবন কাসীর রাহিমাহুল্লাহ বলেন, “কেউ বলেছেন রবিউল আউয়ালের দ্বিতীয় তারিখ। ইবন আব্দুল বার ‘ইস্তি‘আব’ গ্রন্থে এ অভিমত বলেন। ওয়াকেদী এ বর্ণনাটি আবু মা‘শার নাজিহ ইবন আব্দুর রহমান আল-মাদানী থেকেও বর্ণনা করেন।”[7]

দুই. কেউ বলেছেন: রবিউল আউয়াল মাসের আট তারিখ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম জন্মেছেন।

ইবন কাসীর রাহিমাহুল্লাহ বলেন, “কেউ বলেছেন, রবিউল আউয়ালের আট তারিখ, এ বর্ণনাটি হুমাইদি রাহিমাহুল্লাহ ইবন হাযম থেকে বর্ণনা করেন। আর মালেক, উকাইল ও ইউনুস ইবন ইয়াযিদ প্রমুখগণ এ বর্ণনাটি যুহরী থেকে, তিনি মুহাম্মাদ ইবন জুবাইর ইবন মুত‘ঈম থেকে বর্ণনা করেন। ইবন আব্দুল বার বলেন, ঐতিহাসিকগণ এ মতটি বিশুদ্ধ বলেছেন। হাফেয মুহাম্মাদ ইবন মূসা আল-খাওয়ারেযমী এ তারিখের ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিশ্চিত। হাফেয আবুল খেতাব ইবন দিহইয়াহ ‘আত-তানবির ফি মাওলিদিল বাশিরিন নাযীর’ গ্রন্থে এ মতটিই প্রাধান্য দিয়েছেন।”[8]

তিন. কেউ বলেছেন, রবিউল আউয়ালের দশ তারিখ।

ইবন কাসীর রাহিমাহুল্লাহ বলেন, “কেউ বলেছেন, রবিউল আউয়ালের দশ তারিখ। এ মতটি ইবন দিহইয়াহ তার গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। ইবন আসাকের ইমাম আবু জাফর আল-বাকের থেকে এবং মুজালিদ ইমাম শা‘বী থেকে অনুরূপ মতই বর্ণনা করেন।”[9]

চার. কেউ বলেছেন, রবিউল আউয়ালের বারো তারিখ।

ইবন কাসীর রাহিমাহুল্লাহ বলেন, “কেউ বলেছেন রবিউল আউয়ালের বারো তারিখ। ইবন ইসহাক এ মত বর্ণনা করেন। ইবন আবু শায়বাহ তার ‘মুসান্নাফ’ গ্রন্থে এ মতটি আফফান থেকে, সে সাঈদ ইবন মিনা থেকে, সে জাবের ও ইবন আব্বাস থেকে বর্ণনা করে, তারা উভয়ে বলেছেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হস্তী বাহিনীর বছর, রবিউল আউয়াল মাসের বারো তারিখ, সোমবার দিন জন্মেছেন। এ দিনেই তাকে নবুওয়াত প্রদান করা হয়, এ দিনেই তার মি‘রাজ হয়েছিল, এ দিনেই তিনি হিজরত করেছেন এবং এ দিনেই তিনি মারা যান’। জমহুর আলেমদের নিকট এ মতটিই বেশি প্রসিদ্ধ।”[10]

কেউ বলেছেন, রমযান মাস, আবার কেউ বলেছেন সফর মাস ইত্যাদি মতও রয়েছে।

আমাদের কাছে স্পষ্ট যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম রবিউল আউয়াল মাসের আট বা বারো তারিখের কোনো একদিন জন্ম গ্রহণ করেন। কতক মুসলিম গণিত ও জ্যোতির্বিদ গবেষণা দ্বারা বের করেছেন যে, রবিউল আউয়াল মাসের নয় তারিখ-ই মোতাবেক সোমবার হয়! তাহলে এটা আরেকটি মত হলো। এ মতটি শক্তিশালী, এ তারিখ ৫৭১ খৃষ্টাব্দের নিসানের বিশ তারিখ মোতাবেক। বর্তমান যুগের কতক সিরাত লেখক এ মতটিই প্রাধান্য দিয়েছেন, তাদের মধ্যে উস্তাদ মুহাম্মাদ আল-খুদারী ও সফিউর রহমান মোবারকপুরী অন্যতম।

আবুল কাসেম আস-সুহাইলি রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, “গণিতবিদগণ বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্ম সৌর মাস ‘নিসান’-এর বিশ তারিখ মোতাবেক ছিল।”[11]

উস্তাদ মুহাম্মাদ আল-খুদারী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, “মিসরের জ্যোতির্বিজ্ঞানী মরহুম মাহমুদ বাশা, যিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানী, ভূ-গোল, গণিতবিদ্যা, লিখনি ও গবেষণায় ব্যাপক পারদর্শী ছিলেন, (মৃত্যু ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দ) তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্ম ছিল সোমবার সকাল বেলা, রবিউল আউয়াল মাসের নয় তারিখ, মোতাবেক এপ্রিল/নিসান-এর বিশ তারিখ, ৫৭১ খ্রিষ্টাব্দ। এ বছরটি হস্তি বাহিনীর প্রথম বছর মোতাবেক। তিনি জন্ম গ্রহণ করেন বনু হাশেম পল্লীতে আবু তালিবের ঘরে।”[12]

চতুর্থত: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যু: এ ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই যে, তিনি সোমবার দিন মারা গেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বুধবার মারা গেছেন মর্মে ইবন কুতাইবার বর্ণনা বিশুদ্ধ নয়, তবে এর দ্বারা যদি তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাফন করা বুঝান তাহলে ঠিক আছে।

মৃত্যুর বছর: এ ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই যে, তিনি এগারো হিজরীতে মারা যান।

মৃত্যুর মাস: এ ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই যে, তিনি রবিউল আউয়াল মাসে মারা যান; কিন্তু এ মাসের নির্দিষ্ট তারিখের ব্যাপারে আলেমদের মতপার্থক্য রয়েছে:

এক. জমহুর আলেমগণ বলেছেন, রবিউল আউয়াল মাসের বারো তারিখ।

দুই. খাওয়ারেযমী বলেছেন, রবিউল আউয়ালের প্রথম তারিখ।

তিন. ইবনুল কালবি ও আবু মিখনাফ বলেছেন, রবিউল আউয়াল মাসের দ্বিতীয় তারিখ। সুহাইলি ও হাফেয ইবন হাজার এ মতের দিকেই ধাবিত হয়েছেন।

তবে জমহুর আলেমগণের মতই প্রসিদ্ধ যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এগারো হিজরীতে রবিউল আউয়াল মাসের বারো তারিখ মারা যান।[13]

আল্লাহ ভালো জানেন।

সমাপ্ত

শাইখ মুহাম্মাদ সালেহ আল-মুনাজ্জিদ
অনুবাদ: সানাউল্লাহ নজির আহমদ
সম্পাদনা: প্রফেসর ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া


[1] আল-কাওলুল মুবিন ফী সীরাতে সায়্যেদিল মুরসালীন, পৃষ্ঠা ৭৮।
[2] যাদুল মা‘আদ (১/৭৬)।
[3] সুবুল হুদা ওয়ার রাশাদ ফী সিরাতে খাইরিল ইবাদ (১/৩৩৪-৩৩৫)।
[4] আস-সিরাতুন নববিয়াহ আস-সহীহাহ (১/৯৭)।
[5] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১৬২।
[6] আস-সিরাতুন নববিয়াহ (১/১৯৯)।
[7] আস-সিরাতুন নববিয়াহ (১/১৯৯)।
[8] আস-সিরাতুন নববিয়াহ (১/১৯৯)।
[9] আস-সিরাতুন নববিয়াহ (১/১৯৯)।
[10] আস-সিরাতুন নববিয়াহ (১/১৯৯)।
[11] আর-রাওদ্বুল উনুফ (১/২৮২)।
[12] নূরুল ইয়াকীন ফী সিরাতি সাইয়্যিদিল মুরসালীন, পৃষ্ঠা ৯। আরও দেখুন: আর-রাহিকুল মাখতুম, পৃষ্ঠা ৪১।
[13] দেখুন: আর-রওদ্বুল উনুফ, লিস সুহাইলি (৪/৪৩৯-৪৪০); আস-সিরাহ আন-নববিয়াহ লি ইবন কাসীর (৪/৫০৯); ফাতহুল বারি লি ইবন হাজার (৮/১৩০)।

Share on