জুমু‘আর দিন আশি বার দুরূদ পড়লে আশি বছরের গুনাহ মাফ হয়ে যাবে—মর্মে বর্ণিত হাদীস কি সহীহ?
প্রশ্ন: একটি হাদীস সম্পর্কে আমার জিজ্ঞাসা, তা হলো আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, জুমু‘আর দিন আসরের সালাতের পর জায়গা থেকে উঠার পূর্বে যে ব্যক্তি আশি বার নিম্নোক্ত দুরূদটি পড়বে, আল্লাহ তার আশি বছরের গুনাহ মাফ করে দিবেন এবং তার জন্য আশি বছর ইবাদত করার সাওয়াব লিপিবদ্ধ করবেন। তিনি বলেন, যেমন কোনো ব্যক্তি এ যিকিরটি আশি বার বলল, اللهم صل على محمد النبي الأمي وآله وسلم تسليما জানার বিষয় হলো, এ হাদীসটি সহীহ কিনা? এ হাদীসের ওপর আমল করা যাবে কিনা? কারণ অনেক মানুষকে হাদীসটির ওপর আমল করতে দেখি।
উত্তর: আল-হামদুলিল্লাহ।
ইবন শাহীন ‘আত-তারগীব ফি ফাযায়েলীল আমাল’ পৃ. ১৪ তে আওন ইবন উমারাহ থেকে এবং তিনি সাকান আল-বুরজুমী থেকে, তিনি হাজ্জাজ ইবন সিনান থেকে, তিনি আলী ইবন যায়েদ থেকে, তিনি সাঈদ ইবনুল মুসাইয়েব এবং তিনি আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে হাদীসটি বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “আমার ওপর দুরূদ পড়া, পুলসিরাতের উপর নূর। যে ব্যক্তি জুমু‘আর দিন আমার ওপর ৮০ বার দুরূদ পড়বে, তার ৮০ বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।”
পরবর্তী আলিমদের কেউ কেউ হাদীসটি সম্পর্কে নমনীয়তা ও উদারতা প্রদর্শন করেন এবং হাদীসটিকে হাসান বলে আখ্যায়িত করেন, কিন্তু সঠিক কথা হলো, হাদীসটি দুর্বল, শুধু দুর্বল নয়, খুবই দুর্বল। কারণ, এ হাদীসের সনদে তিনজন দুর্বল বর্ণনাকারী রয়েছেন। তারা হলেন.
১- আলী ইবন যায়েদ ইবন জাদ‘আন আল-বাসরী:
হাম্মাদ ইবন যায়েদ রাহিমাহুল্লাহ তার সম্পর্কে বলেন, তিনি হাদীসসমূহকে উলট-ফালট করে ফেলেন।
শু‘বা রাহিমাহুল্লাহ বলেন, তিনি হাদীসকে একটির সাথে আরেকটিকে মিলিয়ে ফেলেন।
ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল রাহিমাহুল্লাহ বলেন, তিনি কিছুই না।
আবু যুর‘আ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, তিনি নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারী নন। ধারণাপ্রসূত কথা বলেন এবং ভুল করেন।
আবু হাতেম রাহিমাহুল্লাহ এ বর্ণনাকারী সম্পর্কে বলেন, তার কথা দ্বারা দলীল দেওয়া যাবে না।[1]
২- হাজ্জাজ ইবন সিনান:
তার সম্পর্কে আযদী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, তিনি মাতরুক, অর্থাৎ মিথ্যা হাদীস বর্ণনাকারী।[2]
৩- আওন ইবন উমারা আল-কাইসী:
আবু যুর‘আহ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, সে মুনকারুল হাদীস অর্থাৎ মিথ্যা হাদীস বর্ণনাকারী।
হাকেম রাহিমাহুল্লাহ বলেন, আমি তাকে পেয়েছি, তবে তার থেকে কোনো হাদীস লিপিবদ্ধ করি নি, তিনি মুনকারুল হাদীস ছিলেন এবং হাদীসে দুর্বল ছিলেন।
ইমাম আবু দাউদ তার সম্পর্কে বলেন, তিনি দুর্বল।[3]
হাদীসের ইমামদের মধ্যে আরও যারা হাদীসটিকে দুর্বল বলে আখ্যায়িত করেন, তারা হলেন, ইমাম দারা ক্বুতনী, হাফেয ইবন হাজার রাহিমাহুমাল্লাহ।[4]
এ হাদীসটির সমর্থনে আনাস ইবন মালেক থেকে অপর একটি হাদীস বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সন্মুখে দাঁড়ানো ছিলাম, তখন তিনি বলেন, জুমু‘আর দিন যে ব্যক্তি আমার ওপর ৮০ বার দুরূদ পাঠ করে, আল্লাহ তা‘আলা তার ৮০ বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন। তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো, হে আল্লাহর রাসূল আপনার ওপর দুরূদ কীভাবে পড়বো? তখন তিনি বললেন, বলবে-
اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ عَبْدِكَ وَنَبِيِّكَ وَرَسُولِكَ النَّبِيِّ الأُمِّيِّ
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা সাল্লি ‘আলা মুহাম্মাদিন ‘আব্দিকা ওয়া নবিয়্যিকা ওয়া রাসূলিকা আন্ নাবিয়্যিল উম্মিয়্যি।[5]
হাদীসটির সনদে ওহাব ইবন দাউদ ইবন সুলাইমান আদ-দ্বরীর নামে একজন বর্ণনাকারী রয়েছেন, ইমাম যাহাবী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ‘খতীব রাহিমাহুল্লাহ তার সম্পর্কে বলেন, তিনি নির্ভরযোগ্য ছিলেন না’। তারপর তিনি তার বানানো একটি হাদীস হিসেবে উক্ত হাদীসটি দলীল হিসেবে উল্লেখ করেন।
অনুরূপভাবে ইবনুল জাওযী রাহিমাহুল্লাহ উল্লিখিত হাদীসটিকে ‘আহাদীসে ওয়াহীয়াহ’ (৭৯৬)-এর মধ্যে উল্লেখ করেন।
আল্লামা আলবানী রাহিমাহুল্লাহ হাদীসটিকে বানোয়াট বলেছেন। তিনি বলেন হাদীস বানানোর বিষয়টি তার মধ্যে স্পষ্ট। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর দুরূদ পাঠ করার ফযীলত বিষয়ে বিশুদ্ধ হাদীসগুলো যথেষ্ট। এ ধরনের মাওদু‘ হাদীসের কোনো প্রয়োজন নেই। যেমন, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “যে ব্যক্তি আমার ওপর একবার দুরূদ পড়ে, আল্লাহ তা‘আলা তার ওপর দশবার দুরূদ পড়েন।” (সহীহ মুসলিম)[6]
মূল: মুহাম্মাদ সালিহ আল-মুনাজ্জিদ
অনুবাদ: জাকের উল্লাহ আবুল খায়ের
সম্পাদক: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
[1] দেখুন: ইমাম আয-যাহাবী, আল-মুগনী ফীদ দ্বু‘আফা (২/৪৪৭)।
[2] দেখুন: হাফেয ইবন হাজার, লিসানুল মীযান (২/৫৬৩)।
[3] দেখুন: তাহযীবুত তাহযীব (৮/১৭৩)।
[4] ‘নাতায়েজুল আফকার’ (৫/৫৬); আল্লামা সাখাবী রাহিমাহুল্লাহ স্বীয় কিতাব ‘আল কাওলুল বাদী’ পৃ. ২৮৪; আল্লামা মুনাবী, ‘ফাইযুল কাদীর’ (৪/২৪৯); কামাল ইউসুফ আল-হুত আল-বাইরূতি তার কিতাব ‘আসনাল মাতালেব’ পৃ. ১৭৫ এবং শাইখ আল-আলবানী স্বীয় কিতাব ‘সিলসিলাতুদ দ্বা‘য়ীফা’ (৮/২৭৪)।
[5] খতীব আল-বাগদাদী, তারীখে বাগদাদ (১৩/৪৬৩)।
[6] দেখুন: ‘সিলসিলাতুল আহাদীস আদ্ব দ্ব‘য়ীফাহ ওয়াল মাওদু‘আহ’ (১/৩৮৩)।